৭৪ প্রজাতির ১২০টি মৃত প্রাণী-পাখি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন্য প্রাণী জাদুঘর। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর এলাকায়
৭৪ প্রজাতির ১২০টি মৃত প্রাণী-পাখি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বন্য প্রাণী জাদুঘর। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর এলাকায়

বন্য প্রাণী জাদুঘর

বয়ামে বাঘের বাচ্চা, কালিম পাখি

একটি ছোট কক্ষে তাকে তাকে সাজানো বয়াম। সেই বয়ামে গেছো ব্যাঙ, দুমুখো সাপ, বিষাক্ত গোখরো, কালিম পাখি, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, লালবুক টিয়া, চিত্রা হরিণের বাচ্চাসহ নানা পশুপাখি। গত রোববার সকালে জাদুঘরে ঢুকে দেখা গেল এসব প্রাণী-পাখির সমাহার।

বিএফআরআইয়ের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় এই অভিনব জাদুঘর। ভেতরে ঢুকে নজর গেল বাঘের বাচ্চা বা শাবকের দিকে। মাত্র তিন দিন বয়সে মারা গিয়েছিল শাবকটি। ১৯৯৯ সালের ১৯ মে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা থেকে বাচ্চাটি সংগ্রহ করা হয়। এর পর থেকে শাবকটির জায়গা হয় জাদুঘরে। চিত্রা হরিণের বাচ্চারও ঠিকানা হয়েছে জাদুঘরে। ১৯৯৭ সালের ১৬ মার্চ এটিও চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা থেকে আনা হয়। হরিণটি যেন বয়ামের ভেতর ভাসছিল।

এখানে আছে ৭৪ প্রজাতির ১২০টি মৃত প্রাণী। তাকের ভেতর ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে খইয়া গোখরো সাপ, গেছো ব্যাঙ, বাঘের বাচ্চা, ঘড়িয়ালে ডিম, জলপাইরঙা কাছিম, পাতি দুধরাজ, শঙ্খিনী। বলতে গেলে, কী নেই এখানে। এ যেন এক টুকরা জঙ্গল, যেখানে প্রাণীরা একে অপরের প্রতিবেশী।

চট্টগ্রামের ষোলশহরের পাশেই যেন সবুজের এক গ্রাম। পাহাড়, বন ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদে ভরা পরিবেশ। সেই অনন্য পরিবেশে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) অবস্থান। এ ইনস্টিটিউটেই গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটি।

১৯৭৮ সালে বিএফআরআইয়ের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ মৃত পশুপাখি সংগ্রহ করা হবে। উদ্দেশ্য ছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্মৃতিচিহ্ন রাখা। আজ সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ঘুরতে আসেন। কেউ কেউ মৃত অথচ বৈচিত্র্যময় এসব প্রাণী দেখে বিস্মিত হন।

জাদুঘরটি দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পশুপাখি সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে এটি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।
মো. আনিসুর রহমান, জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা, বিএফআরআই।

বিএফআরআইয়ের জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জাদুঘরটি দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পশুপাখি সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে এটি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে।

দেশে দিন দিন গুইসাপের পরিমাণ কমছে। বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও নগরায়ণের ফলে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই গিরগিটি প্রজাতির প্রাণী। প্রাণীটি পরিবেশে খুব উপকারী, বিশেষ করে এটি ক্ষতিকর পোকামাকড়, ইঁদুর খেয়ে সাবাড় করে, যা পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। জাদুঘরে গুইসাপের একটি বাচ্চাও রয়েছে। ১৯৯২ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়।

বাঘের বাচ্চার মৃতদেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে জাদুঘরে

পাখিদের সংগ্রহশালা জাদুঘরের আরেকটি আলাদা জগৎ। কক্ষের এক কোনার তাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লালবুক টিয়া ও ময়না। কিন্তু চোখ আটকে যায় কালিম বা বেগুনি জলচর পাখির দিকে। কালিম পাখিটি ২০১৭ সালের ৩ জুন ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় না থাকলেও, বাংলাদেশে এটি কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সাধারণত জলাধারের কাছাকাছি পাওয়া যায় এ পাখি। কিন্তু ক্রমাগত জলাধার ভরাটের ফলে তার আবাস হারাচ্ছে।

পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রাণীগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কাচের বয়ামে রাখা অধিকাংশ নমুনার ভেতরে ‘ফরমালডিহাইড দ্রবণ’ ব্যবহার করা হয়। প্রতিবছর এই দ্রবণ পরিবর্তন করা হয়, যাতে মৃত প্রাণী ‘বেঁচে থাকার’ মতো শোভা ধরে রাখতে পারে।

পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রাণীগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কাচের বয়ামে রাখা অধিকাংশ নমুনার ভেতরে ‘ফরমালডিহাইড দ্রবণ’ ব্যবহার করা হয়। প্রতিবছর এই দ্রবণ পরিবর্তন করা হয়, যাতে মৃত প্রাণী ‘বেঁচে থাকার’ মতো শোভা ধরে রাখতে পারে।

জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান জানান, পাহাড়ি ময়না, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, পাতিহাঁস, লালবুক টিয়া, সবুজ টিয়া, সুন্দরী হাঁস, ভাতশালিক, ঝুঁটি শালিক, কালিম ও খইয়া গোখরো সাপ—সবই ট্যাক্সিডার্মি পদ্ধতিতে সংরক্ষিত। ট্যাক্সিডার্মি হলো চামড়া সংরক্ষণ করে নকল কাঠামোর ওপর বসিয়ে প্রাণীকে জীবন্তের মতো দেখানোর একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকে স্টাফিং বা প্রস্তুতকরণও বলা হয়। এটি সাধারণত গবেষণা, প্রদর্শন বা ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য করা হয়।

জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, এই জাদুঘর শুধু প্রদর্শনীর জন্য নয়; এটি শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রজন্মকে সচেতন করার একটি স্থান। মৃত প্রাণীর ভেতর দিয়ে জীবনের চিরন্তন গল্প শোনায় এই জাদুঘর।