
রংপুরের পীরগাছায় তিন ফসলি জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে অন্তত ৪১ একর জমির ধানসহ বিভিন্ন সবজি ও ফল নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ বিষয়টি তদন্ত করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করলেও কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। কৃষকদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণ দাবি করায় তাঁদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
মেসার্স শিল্পী এন্টারপ্রাইজ (এমএসবি ব্রিকস) নামে এই ইটভাটাটি পীরগাছা উপজেলার বামন সরদার এলাকায় অবস্থিত। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এই ইটভাটাটি অবৈধ। তবে ইটভাটার মালিক মমিনুল ইসলামের দাবি, তাঁরা হাইকোর্টে রিট করে ইটভাটা পরিচালনা করছেন।
বামন সরদার এলাকার কৃষকদের অভিযোগ, দুই সপ্তাহ আগে এমএসবি ব্রিকসের আগুন নেভানোর জন্য বিষাক্ত গ্যাস ছাড়া হয়। এতে ভাটাসংলগ্ন উত্তর পাশের জমির ধান, সবজি, গাছের আমসহ বিভিন্ন ধরনের ফল নষ্ট হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসে অন্তত ৫০-৬০ জন কৃষকের প্রায় ৪০-৪৫ একর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত বছরও ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে স্থানীয় কৃষকদের ফসল নষ্ট হয়েছিল।
কৃষক দেনোনাথ বর্মণ বলেন, তিনি ৩৬ শতাংশ জমিতে ব্রি-১০২ জাতের ধান রোপণ করেন। ধানের থোড় এসেছে। এমন সময় ভাটার ধোঁয়ায় সব ধান গাছ পুড়ে গেছে। পরে ভাটায় যান তিনি। সেখানে মালিক তাঁকে বলেন, ‘ধান ঢাকায় যাবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে, তারপর জরিমানা দিব। এর আগে যদি কোনো আলাপ করেন, বাড়াবাড়ি করেন, এক টাকাও দিব না।’ ইটভাটার মালিক বিএনপি করায় ক্ষমতায় প্রভাব দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন আরেক কৃষক সুশান্ত চন্দ্র বর্মণ।
মমিনুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর ইটভাটা নিয়ে কথা হলে তিনি রংপুর মহানগর বিএনপির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন বলে দাবি করেন। খোঁজ নিয়ে তাঁর দাবির সপক্ষে তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার জানতে চাইলে মমিনুল বলেন, ‘আমি বিএনপি করি। কিন্তু কোনো পদে ছিলাম না।’
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ এপ্রিল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মুকিব বিন লিয়কতকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটি সরেজমিনে খোঁজ করে ৪১ একর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ১ মে ইউএনওর মধ্যস্থতায় কৃষক ও ইটভাটার মালিক বৈঠকে বসেন। সেখানে ফসল ক্ষতিগ্রস্তের হার নির্ণয় অনুযায়ী শতাংশে ৫০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ইটভাটার মালিক পরে সে সিদ্ধান্ত মেনে নেননি।
অবশ্য কৃষকদের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ইটভাটার মালিক মমিনুল ইসলাম। তবে তাঁর দাবি, ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ বেশি দেখানো হয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাছে দলের প্রভাব দেখানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, ইটভাটার মালিক কৃষি বিভাগের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে আপত্তি তোলায় এখন পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলছে।
কৃষক বাদশা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভাগ্যাহত কৃষক। আমরা কীভাবে চলব। এই ধানের ওপর সবকিছু নির্ভরশীল। টিএনও (ইউএনও) স্যার আমাদের ১৫ দিন থাকি ঘুরাইতেছে। টালবাহানা করতেছে। ওনার (ইউএনও) কাছেও বিচার পাচ্ছি না। আমরা কোথায় যাব। আমরা কৃষক মানুষ। মন্ত্রণালয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে কি সম্ভব?’
ইটভাটা পরিচালনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসন এবং বন বিভাগের অনুমতি লাগে। পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, রংপুরের মোট ২১৬টি ইটভাটার মধ্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র ও নবায়ন (হালনাগাদ) প্রাপ্ত ইটভাটার সংখ্যা ৩৫টি। পীরগাছার ২৩টির মধ্যে ১টিরও পরিবেশের ছাড়পত্র নেই।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেসার্স শিল্পী ব্রিকসের অনুমোদন ছিল। এরপর আর নবায়ন করা হয়নি। তাহলে অবৈধ ইটভাটাটি কীভাবে চলছে, জানতে জানলে ইউএনও নাজমুল হক বলেন, এই ইটভাটাসহ কিছু ইটভাটার মালিক হাইকোর্টে রিট করেছেন। এ কারণে ইটভাটা ভাঙার সুযোগ হয়নি। তবে তাঁরা অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছেন। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, এমএসবি ব্রিকস ইটভাটাতে মেডিকেল বর্জ্য ও পুরোনো স্যান্ডেলসহ প্লাস্টিক পোড়ানো হয়। এতে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।