
পেছনেই আটতলা ফাঁকা ভবন। নিচতলার পুরো অংশ ফাঁকা। ভবনের সামনে খোলা আকাশের নিচে গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছেন পাঁচ নারী। তাঁরা তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনার ১৩ বছর পূর্তিতে তাঁরা ক্ষতিপূরণ, পুর্নবাসন ও দোষী ব্যক্তিদের বিচারের দাবি নিয়ে এসেছেন।
ওই পাঁচ নারীর মধ্যে নাটা বেগম নামের একজন বলেন, ‘গতকাল রাইতে গোপালগঞ্জ থিকা আইছি। তাজরীনের তিনতলায় বুয়ার কাজ করতাম। ওই দিন জানলা দিয়া লাফাইয়া বাঁচছি। আমাগো ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন আরও অনেকে।
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে পাটি বিছিয়ে গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছেন বিভিন্ন বয়সের পাঁচ নারী। পেছনে বহুতল ভবনটির দ্বিতীয় তলার ফটকে ঝুলছে তালা। ভেতরের দেয়াল ও ছাদে দেখা যায় আগুনের ক্ষতচিহ্ন। বিভিন্ন তলার ভাঙা জানলা। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মী, নিহত শ্রমিকদের স্বজন ও আহত শ্রমিকেরা ভবনের সামনে জড়ো হচ্ছেন নিহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে।
ভবনের সামনে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থাকা রংপুরের মাহমুদা বেগম (৪০) বলেন, ‘ওই দিন সন্ধ্যায় আগুন নাগছে (লাগছে)। যখনই অ্যালার্ম বাজছে, আমরা দৌড় পারিয়া নামতেছি। তিনতলা পর্যন্ত নামছি। দেহি গেটে তালা মারা। বাইর হওয়ার কোনো রাস্তা নাই। তারপর গ্লাস রুমত (রুমে) ঢুকছি। দেখি মানুষ লাফ দিয়া বাইর হইতাছে। বাইর হইতে যাইয়া নিচে পইরা গেছি। মাথায়, ঘাড়ে আঘাত পাইছিলাম।’
মাহমুদা বেগম আরও বলেন, ‘ওই দিন তো আগুন থিকা বাঁচছি। ভয় লাগে ভবন ভাঙলে মইরা যামু। তাই এইখানে ঘুমাইছি। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই, মালিকের শাস্তি চাই।’
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন আরও অনেকে।
তাজরীন ট্যাজেডির দিন ছাদ থেকে অনেককে পাইপ বেয়ে নিচে লাফিয়ে পড়তে দেখেছেন মাদারীপুরের খাদিজা আক্তার (২৫)। ভয়াবহ সেই দিনের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ছয়তলায় সুইংয়ের হেলপার ছিলাম। সন্ধ্যার সময় ফায়ার অ্যালার্ম বাজছে। দেখি, সবাই দাপাদাপি করতাছে। নিচতলা থিকা উপরে, উপরতলা থিকা নিচে নামতাছে। একতলা নিচে নাইমা দেখি ধোঁয়া। পরে ছাঁদে উঠছি। ছাঁদ থিকা দেখছি বাথরুমের পাইপ বাইয়া পাশে মাগুর মাছ চাষ করত ওইখানে অনেকে লাফ দিছে। ওখানে বাঁশের কঞ্চি কারও পেটে ঢুকছে, কারও চোখে ঢুকছে।’
খাদিজা আক্তার আরও বলেন, ‘আমি লাফ দিতে সাহস পাই নাই। অন্য পাশ দিয়া নামার চেষ্টা কইরা নিচে পইরা গেছি। মাথায় আঘাত পাইয়া তিন বছর পাগলের মতো ছিলাম। মা-বাপ চিনি নাই। স্বামী ছাইরা চইলা গেছে। মাথায় ডিস্টার্ব (মানসিক সমস্যা)। ডাক্তার দেখাইতে হয়। ভিটামাটি বিক্রি কইরা দিছি। আমরা বাঁচতে চাই।’
তাজরীনের ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ১৩ বছরের দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসন নিশ্চিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তদন্ত প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। বিগত সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তাঁদের পুনর্বাসন না করে উল্টো দায়ী তাজরীনের মালিককে পুরস্কৃত করেছে। তাজরীনের অগ্নিকাণ্ড থেকে কেউ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। উল্টো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে পোশাক কারখানায় আগুন ঘটনাগুলো একইভাবে ঘটেছে।
খায়রুল মামুন আরও বলেন, ‘এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড় বছর হলেও সেই আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি। তাজরীন ট্যাজেডির ১৩ বছর পূর্তিতে আমাদের দাবি, সরকারের দেওয়া আশ্বাসের দ্রুত বাস্তবায়ন, তাজরীনের মালিকসহ দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’