
‘মুন্না করবে জয়, বাবু করবে জয়, ওহ্ বুকের গভীরে আমরা জেনেছি, আমরা করব জয় একদিন...।’ ১৯৮৯ সালের মার্চের বিকেলগুলোতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন গান গেয়ে প্রচারণা চালাতেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বড় অংশের নারী কর্মীরা। সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে এই পরিষদের ভিপি প্রার্থী রাগীব আহসান মুন্না (বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী) ও জিএস প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস বাবুকে (ছাত্রলীগ, মু-না) নিয়ে বাঁধা হয়েছিল ‘আমরা করব জয়...’ গানের এই প্যারোডি, যা সাড়া ফেলেছিল ভোটারদের মধ্যে।
৩৫ বছর পর আবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে রাকসু নির্বাচন। তখনকার নির্বাচনের সঙ্গে এই নির্বাচনের বড় পার্থক্য হচ্ছে তখন মুঠোফোনের যুগ ছিল না। মুখে মুখে গান গাওয়া আর মিছিলে স্লোগান দেওয়া ছিল প্রচার-প্রচারণার একটি বড় মাধ্যম। নির্বাচনের মাঠে ছিল না কোনো টেলিভিশন ক্যামেরাও।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, তৎকালীন শিক্ষার্থী ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়েছিল ২৫ মার্চ। ১৯৮০ সালের পর ১০ বছর বাদ দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই নির্বাচন। এটি ছিল রাকসুর ত্রয়োদশ নির্বাচন। খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। তার পরের বছর ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল সর্বশেষ নির্বাচন। এই নির্বাচনের তারিখ ছিল ২৫ জুন। কিন্তু এক মাস পিছিয়ে ২৯ জুলাই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও আগের চারটি প্যানেল থেকেই প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। প্যানেলগুলো ছিল এই রকম, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের বড় অংশের (মুন্না-বাবু) প্যানেলে ছিল বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ছাত্রলীগ (মু-না), ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ঐক্য সমিতি, ছাত্রলীগ (আ-মো) ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। অপর অংশটিতে শাহ আলম-রায়হান প্যানেল ছিল ছাত্রলীগ (সু-র) আর জাতীয় ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রিজভী-মুরাদ প্যানেল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের লতিফ-রফিক প্যানেল। একই ছিলেন ভিপি-জিএস প্রার্থীরা। প্যানেলের কর্মীরা তাই একই গান গেয়ে পরের নির্বাচনে ভোটারদের নজর কাড়ার চেষ্টা করেছিলেন।
তখন রাকসুর পদ ছিল ১৮টি। ১৯৮৯ সালের রাকসুতে এই ১৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ১৭২ জন প্রার্থী। এবারের নির্বাচনে ১০টি প্যানেল হয়েছে। ২৩ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৪৭ জন। ৩৫ বছর পর নির্বাচনের ভোটার বেড়েছে ১১ হাজার ২৬ জন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার নির্বাচনে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
তখন নির্বাচন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে পুরাতন ছাত্রের ভর্তির রেওয়াজ ছিল। এবারও যেটা করার দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত হয়নি। সে সময় ভর্তির সুযোগের কারণে ১৯৮০ সালের শহীদ হবিবুর রহমান হল সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা আলী রায়হান। ১০ বছর পরে তিনি ‘৮৯–এর রাকসু নির্বাচনে শাহ আলম-রায়হান প্যানেল ছাত্রলীগ (সু-র) থেকে জিএস প্রার্থী হয়েছিলেন সেই আলী রায়হান। অনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়া নামকরা খেলোয়াড় শাহ আলমকে আবার ভর্তি করে এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী করা হয়েছিল। একইভাবে পরের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন রবিউল আলম বুদু ও শরীফুল ইসলাম।
এবার রাকসু নির্বাচনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদের প্রার্থীরা গান গেয়ে, অভিনয় করে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। সেগুলো আবার মুঠোফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। খুদে বার্তার মাধ্যমেও ভোট চাইছেন প্রার্থীরা। আবার কোনো টেলিভিশন সাংবাদিকেরা কোনো প্রার্থীর যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তখন সেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার দৃশ্যটি আলাদা মুঠোফোনে ধারণ করে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। তখনকার দিনে এই সুবিধা ছিল না। হলগুলোর সামনে মঞ্চ তৈরি করে নির্বাচনী সভা করা হতো। সেখানে সাংস্কৃতিক পর্বও থাকত।
১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালের দুটি নির্বাচনেই ‘আমরা করব জয়...’ গানটি জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি গানও প্রচার পেয়েছিল। তিন-চারটি সংগঠন মিলে ঐক্য প্যানেল করার কারণে প্রতিপক্ষকে কটাক্ষ তাঁরা করে গাইতেন, ‘লতিফ ভাইয়ের ভয়ে রে, রফিক ভাইয়ের ভয়ে রে, জোড়াতালি দিল রে।’ দুটি নির্বাচনেই ছাত্রশিবিরের ভিপি-জিএস ছিলেন লতিফ-রফিক। তাঁদের নাম ধরেই তাঁরা সুরে সুরে এই গান গাইতেন।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ মিলে ১৯৮৯–এর প্যানেল হয়েছিল। সেবার তাদের স্লোগান ছিল ‘শাহ আলম-রায়হান-শরীফুল রাকসুর তিন ফুল।’ মৈত্রী, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে যে প্যানেল হয়েছিল, তার স্লোগান ছিল ‘মুন্না-বাবু আলমগীর, রাকসুর তিন বীর’। ছাত্রদলের ৯০–এর নির্বাচনের স্লোগান ছিল ‘রিজভী-হারুন বাহার, রাকসুর সমাহার’। শেষ নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একা নির্বাচন করেছিল। রবিউল আলম বুদু তাদের ভিপি ও জিএস প্রার্থী ছিলেন শরীফুল ইসলাম আর আবদুল হান্নান ছিলেন এজিএস। তাদের স্লোগান ছিল ‘বুদু-শরীফ-হান্নান, রাকসুর তিনটি নাম’।
সংবাদ কাভারেজ নিয়ে পত্রিকাগুলোর এত মাতামাতি ছিল না। ছিল না এখনকার মতো অনলাইনে প্রতি মুহূর্তের সবশেষ খবর। ‘৮৯–এর রাকসু নির্বাচনের দিনে জাতীয় দৈনিক সংবাদে প্রথম পাতায় এক কলামে ছাপা হলো ‘আজ রাকসু নির্বাচন।’ অবশ্য ফল প্রকাশের দিন প্রথম পাতায় নির্বাচিত ভিপি-জিএসের ছবি দিয়ে দুই কলাম নিয়ে একটি ছোট জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ‘৯০–এর নির্বাচনে সংবাদে প্রথম পাতায় দুই কলাম জায়গা পেয়েছিল ‘আজ রাকসু নির্বাচন।’ নির্বাচনের পরের দিন ইত্তেফাক প্রথম পাতায় দুই কলামে ছেপেছিল ‘নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন।’
প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল, ওই সময় নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ২৫ প্লাটুন দাঙ্গা পুলিশ। আর এবার থাকছে ২ হাজার পুলিশ আর ১৮ প্লাটুন বিজিবি-র্যাব। তিনটা জিনিস তখনকার নির্বাচনে ছিল না, তা হলো র্যাব, মুঠোফোন ও টেলিভিশন ক্যামেরা।