অনেক শিক্ষার্থী পারভেজ ব্যাপারীর ফুচকার ভক্ত। সম্প্রতি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মতলব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকের পাশে
অনেক শিক্ষার্থী পারভেজ ব্যাপারীর ফুচকার ভক্ত। সম্প্রতি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার মতলব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকের পাশে

‘কষ্ট কইরা ফুচকা বেইচা সংসার চালাই, তবু কেউই আমার দুঃখ বোঝে না’

প্রতিদিন সাতসকালে ফুচকার ডালা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন পারভেজ ব্যাপারী। সারাদিন এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল, কখনো এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘোরেন। ফুচকা বেচে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা থেকে ১০টা বেজে যায়। তবু সংসারের হিসাব মেলে না তাঁর। পারভেজের ভাষায়, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমতাছে না। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। এলিগা সংসারের হিসাব মিলাইতে পারি না। প্রতি মাসে ধারদেনা করন লাগে। শীতে কাম করতে খুব কষ্ট অয়। তবু কাম করতাছি। কী করুম, কাম না করলে খামু কী?’

৪৫ বছর বয়সী পারভেজ ব্যাপারীর বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার পূর্ব কলাদী এলাকায়। ১৫ বছর ধরে উপজেলা সদরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফটকের সামনে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পথচারীদের কাছে নিজের বানানো ফুচকা বিক্রি করছেন। কয়েক দিন আগে তাঁর দেখা পাওয়া যায় উপজেলার মতলব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকের সামনে। সেখানে ছোট ছোট শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও পথচারীদের কাছে ফুচকা বিক্রি করছিলেন তিনি। এর ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতায় উঠে আসে তাঁর জীবনের নানা প্রসঙ্গ।

দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পারভেজ সবার বড়। পূর্ব কলাদী এলাকায় এক ভাই, এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার। পারভেজ ব্যাপারী বলেন, তাঁর পৈতৃক জমিজমা নেই। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় হওয়ায় ১৫ বছর বয়স থেকে সংসারের হাল ধরেছেন। তাঁর বাবা চারু ব্যাপারীর তেমন উপার্জন ছিল না। প্রথমে কয়েক বছর রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রিকশা চালাতে অনেক কষ্ট ও পরিশ্রম হয়। এ জন্য ২০০৯ সাল থেকে ফুচকা বিক্রির কাজ করছেন। উপজেলা সদরের মতলব সরকারি কলেজ, মতলব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নবকলস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কচি–কাঁচা প্রি-ক্যাডেট স্কুলসহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ফুচকা বিক্রি করেন। তাঁর ক্রেতাদের বেশির ভাগই স্কুলের খুদে শিক্ষার্থী। সঙ্গে অভিভাবকেরা থাকলে মাঝেমধ্যে তাঁরাও ফুচকা কিনেন।

কারও কাছে ভিক্ষা বা সাহায্য চাওয়ার চেয়ে নিজে পরিশ্রম করে সংসার চালানোকেই উত্তম মনে করেন পারভেজ। তিনি বলেন, ‘সৎ পথে রুজি কইরা দুইডা খাওন জুডাইতে পারলে হেনোই শান্তি।’ তবে সেই কষ্ট যখন সংসারের অন্যরা বুঝতে চায় না, তখন দুঃখবোধ হয় তাঁর। তিনি বলেন, ‘শরীর খারাপ থাওনে মাঝেমধ্যে কামও করতে পারি না। কোনোরহমে খাইয়া না–খাইয়া আছি। প্রচণ্ড শীতেও অনেক কষ্ট কইরা ফুচকা বেইচা সংসার চালাই। তয় সংসারের জন্য এতকিছু করি, তবু সংসারের কেউই আমার দুঃখ বোঝে না।’

১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কাগজের প্যাকেটে করে ফুচকা বিক্রি করেন পারভেজ ব্যাপারী। হিসাব কষে তিনি জানালেন, খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন আয় করেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। মাসে আয় করেন ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে এবং শরীর অসুস্থ থাকলে তখন কাজে আসেন না। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। প্রতিদিন কাজ করতে পারেন না। মাসে যা আয় হয়, তা দিয়ে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও ভাইবোনদের ভরণপোষণ চালাতে হয়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের সবার কাপড়চোপড় কেনা এবং ওষুধপত্রও কিনতে হয় এ টাকা থেকে।

পারভেজ ব্যাপারীর ফুচকার ভক্ত উপজেলার কলাদী এলাকার ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার। তাঁর ভাষায়,  ‘পারভেজ চাচা খুব ভালা। পয়সা না থাকলে মাঝেমধ্যে এমনিতেই আমাগো ফুচকা খাইতে দেন। তাঁর বানানো ফুচকা খুব মজা।’

মতলব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকের সামনের ফটোকপি দোকানি জহিরুল ইসলাম এই ফুচকা বিক্রেতাকে ভালোভাবে চেনেন। তিনি বলেন, ‘পারভেজ ব্যাপারী পরিশ্রমী ও ভদ্র। তিনি সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। তাঁর হাতের বানানো ফুচকা সবার প্রিয়। টাকা না থাকলে এমনিতেই বাচ্চাদের ফুচকা খেতে দেন। নিরক্ষর হলেও তাঁর মানবিক গুণাবলি প্রশংসা করার মতো।’