
শুধু চলতি বছরের ১১ মাসে ৬০ ট্রলারসহ ৩৫৭ জেলেকে অপহরণ করেছে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে বিজিবির তৎপরতায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ১৮৯ জেলেকে। বাকি জেলেরা আরাকান আর্মির হাতে বন্দী রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।
চলছে নভেম্বর মাস। কক্সবাজারে সাগর-নদীতে এখন মাছ ধরার ভরা মৌসুম। প্রতিবছরই এ সময়টাতে জেলেরা দল বেঁধে মাছ ধরতে সাগরে ও নদীতে যেতেন। তবে এ বছর ব্যতিক্রম। মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) আতঙ্কে মাছ ধরছেন না জেলার টেকনাফ উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার জেলে।
জেলেরা জানান, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী ও সাগরে মাছ শিকারে নামলেই আরাকান আর্মি ট্রলারসহ জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে আরাকান আর্মির তৎপরতা কিছুটা কম থাকলেও চলতি নভেম্বরে ধরে নেওয়ার হার বেড়েছে। এ মাসে পৃথক পাঁচটি ঘটনায় ২৯ জেলেকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। এ নিয়ে জেলেপল্লিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভরা মৌসুমে মাছ ধরতে না পারায় অনটনেও দিন যাচ্ছে অনেকের।
সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ সাগরে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। কিন্তু ট্রলার নিয়ে সেখানে গেলেই আরাকান আর্মি তাড়া করে। মাঝেমধ্যে গুলি ছুড়ে ট্রলারসহ জেলেদের জিম্মি করছে। এই আতঙ্কে অন্তত পাঁচ হাজার জেলে মাছ ধরতে সাগরে নামতে পারছেন না।সাজেদ আহমেদ, সভাপতি, টেকনাফের কায়ুকখালী ট্রলার মালিক সমিতি।
সর্বশেষ গত বুধবার ভোরে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়া দ্বীপের দক্ষিণ থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলারসহ ১০ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এর আগের দিন মঙ্গলবার গভীর রাতেও একই এলাকা থেকে একটি ট্রলারসহ ৬ জেলেকে নিয়ে যাওয়া হয়। চলতি মাসের ১২ নভেম্বরও ১৩ জেলেকে নিয়ে যায় তারা। গতকাল শনিবার পর্যন্ত এই ২৯ জেলের একজনকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়নি।
দেখা গেছে, টেকনাফের কায়ুকখালী ঘাটেই দুই শতাধিক মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করা রয়েছে। আর উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ঘোলাপাড়ার ঘাটেও নোঙর করা আছে শতাধিক ট্রলার।
জানতে চাইলে টেকনাফের কায়ুকখালী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমেদ বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ সাগরে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। কিন্তু ট্রলার নিয়ে সেখানে গেলেই আরাকান আর্মি তাড়া করে। মাঝেমধ্যে গুলি ছুড়ে ট্রলারসহ জেলেদের জিম্মি করছে। এই আতঙ্কে অন্তত পাঁচ হাজার জেলে মাছ ধরতে সাগরে নামতে পারছেন না।’
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, ট্রলারসহ ধরে নিয়ে যাওয়া জেলেদের ফেরত আনার বিষয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। এর আগে আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিবি যোগাযোগ করে কয়েক দফায় দেড় শতাধিক অপহৃত বাংলাদেশি জেলেকে টেকনাফে ফেরত আনা হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্য দখলের পর আরাকান আর্মি নাফ নদীর মিয়ানমার অংশে মাছ আহরণসহ নৌকা চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এ বিষয়ে টেকনাফের জেলেদের সতর্ক করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশি জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে মিয়ানমারের জলসীমা অতিক্রম না করেন।’
গত ৮ এপ্রিল সেন্ট মার্টিন–সংলগ্ন এলাকা থেকে ট্রলারসহ আরাকান আর্মির অপহরণের শিকার হয়েছিলেন ২৩ জেলে। তাঁদের একজন মো. রফিক। গত ছয় মাসেও তাঁকে ফেরত আনতে পারেনি বিজিবি। মো. রফিকের স্ত্রী সলিমা খাতুন বলেন, ‘স্বামীর আয়ে চলছিল পাঁচ সদস্যের সংসার। তবে স্বামী কখন ফিরবেন, সেটিরও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। সন্তানদের মুখে একবেলা খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
অবশ্য শুধু সলিমা খাতুন নয়। তাঁর মতো অবস্থা আরও কয়েক শ পরিবারের। বিজিবি সূত্র জানায়, শুধু চলতি বছরের ১১ মাসে ৬০ ট্রলারসহ ৩৫৭ জেলেকে অপহরণ করেছে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে বিজিবির তৎপরতায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ১৮৯ জেলেকে। বাকি জেলেরা আরাকান আর্মির হাতে বন্দী রয়েছেন। তাঁদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।
কয়েক মাস আগে বিজিবির সহায়তায় দেশে ফিরে আসা জেলে আবদুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আরাকান আর্মি বাংলাদেশি জেলেদের রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না, এটি জানতে চান। এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে তাঁদের মারধরও করা হয়।
জেলেদের কষ্ট এখানেই শেষ নয়। টেকনাফের জেলেরা সাধারণত সেন্ট মার্টিন–সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদীতে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে আরাকান আর্মির আতঙ্কে মাছ ধরতে না পারায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঋণ করছেন অথবা বিকল্প পেশার খোঁজ করছেন।
টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে টানা আট বছর টেকনাফের জেলেরা নাফ নদীতে মাছ শিকারে যেতে পারেননি। কয়েক মাস আগে সীমিত সময়ের জন্য নাফ নদী উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু আরাকান আর্মির গুলি ও অপহরণ আতঙ্কে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এটার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।