ফুল

কাঞ্চনলতার স্নিগ্ধ শোভা

টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে ফুটেছে কাঞ্চনলতা
ছবি: লেখক

কাঞ্চন ফুলের সহজলভ্য কয়েকটি রকমফের ভালোই চেনা। কিন্তু কাঞ্চনলতা ছিল একেবারেই অচেনা। আগেই জেনেছি, মধুপুরের বনে পাওয়া যায় গাছটি। তবে যেতে হবে ফুলের মৌসুম হিসাব করে। টাঙ্গাইলে মধুপুরের বন বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকবারই দেখা হয়েছে। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই বনও বছরে কয়েকবার বদলে যায়। ফলে সারা বছরই সেখানে আমাদের জন্য নানান বৈচিত্র্য অপেক্ষা করে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মে মাস পর্যন্ত সেখানে ফুলের আধিক্য থাকে। কারণ, কয়েক মাসের শীতঘুমের পর তখন জেগে ওঠে বন। এমন একটি সময়েই বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে কাঞ্চনলতার দেখা পেলাম। বানরকলার স্নিগ্ধ লাল ফুলগুলোর ছবি তুলে কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ল ফুলটি। অদূরে হাড়গজা গাছের পত্রহীন ডালে অজস্র নবীন ফল ঝুলছে। মধ্য দুপুরেও বনের ভেতর আলোর স্বল্পতা অনুভূত হলো। তাই ছবি তুলতে বেশ কসরত করতে হলো। ছবি তুলতে তুলতে মন ভরে দেখে নিয়েছি ফুলটি। প্রকৃতিজুড়ে কত বৈচিত্র্যই না আছে। যে কাঞ্চন রীতিমতো বৃক্ষ, সে কাঞ্চনই আবার লতা!

প্রায় দেড় শ বছর আগে বাংলা সাহিত্যে উপমা হিসেবে এই ফুলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ১৮৭৫ সালে নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সরোজিনী নাটকে কাঞ্চনলতার উল্লেখ করেছেন। নাটকের একটি চরিত্রের নাম উর্ম্মি, তিনি বলছেনÑ‘তা আর বলতে আবার? সরোজ আমার যেমন কাঞ্চনলতা, তেম্নিœসহকার তরুটীও যুটেচে।’ তবে আরও আগে ষোড়শ শতাব্দীতে কবি গোপাল দাসের ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ ও মহাকবি কালিদাসের রচনায়ও কাঞ্চনলতার প্রসঙ্গ রয়েছে। কালিদাস বলছেনÑ‘মারী।Ñবৎস! চিরং জীবন্ তবে কাঞ্চনলতা ঋতুসমাগমের চিহ্নস্বরূপ কুসুম ধারণ করুন॥’ এসব সংলাপ থেকে অনুমেয়, কাঞ্চনলতা একসময় বেশ পরিচিত একটি ফুল ছিল।

উদ্ভিদটি স্থানীয়ভাবে চেহুর, তাউ, চিহুল ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এটি মধুপুর ছাড়া অন্যান্য শালবন এবং পাহাড়ি বনে পাওয়া যায়। তবে সংখ্যায় কম। কাঞ্চনলতা (Bauhinia vahlii) বেশ বড় আকারের কাষ্ঠল আরোহী, ৯ মিটারের বেশি লম্বা হতে পারে, কাণ্ড পুরু। সুউচ্চ বৃক্ষে বিশৃঙ্খলভাবে ঠাসাঠাসি করে বেড়ে ওঠে। তরুণ বিটপ আকর্ষী যুক্ত। পাতা বেশ বড়, সরল, আগার দিকে গভীরভাবে দুভাগে বিভক্ত। একসময় পাতায় মুড়িয়ে সওদাপাতি বিক্রি হতো। মঞ্জরিদণ্ড লম্বা, ফুল ছোট, ঘিয়ে-সাদা রঙের। তবে পরিণত ফুল ঈষৎ হলদে। ফল শিমের মতো। বর্তমানে গাছটিকে বিপন্ন মনে করা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সহজলভ্য। দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় এবং চওড়া ও ঘনবদ্ধ পাতার আচ্ছাদনের কারণে মাটির ক্ষয় রোধে এই গাছের ভূমিকা অনন্য। আঁশ, খাদ্য, পানীয় ও ভেষজগুণের জন্যও গাছটি গুরুত্বপূর্ণ। এর বীজ বলকারক ও কামোদ্দীপক। শ্লেষ্মাযুক্ত পাতার রস প্রশান্তিদায়ক। কাণ্ডের বাকল ট্যানিনযুক্ত। ভারতের কোনো কোনো সম্প্রদায় এই গাছের পাতা থালা, পেয়ালা ও ছাতা হিসেবে ব্যবহার করে। ভুটান ও বাংলাদেশে বাকলের আঁশ থেকে শক্ত দড়ি তৈরি করা হয়। স্বাদের দিক থেকে কিছুটা কাজুবাদামের মতো হওয়ায় উত্তর ভারতের আদিবাসীরা এর বীজ খেতে পছন্দ করে। সাধারণত বীজ থেকেই বংশ বৃদ্ধি।