প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ফেরার কোনো জায়গা নেই

নিজ দেশে জলবায়ু বিপর্যয়ে নিউইয়র্কে ঠাঁই, সেখানেও বিতাড়নের ভয়

কলাম্বিয়া জার্নালিজম ইনভেস্টিগেশন (সিজেআই) এবং ডকুমেন্টেড–এর যৌথ উদ্যোগে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির সহপ্রকাশক যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান। বাংলাদেশে প্রথম আলো এবং গুয়াতেমালায় প্লাসা পুবলিকা এটির পুনঃপ্রকাশ করছে।

মালিক গাই সুভাঞ্জনা দাস এই প্রতিবেদন তৈরি ও অনুবাদে সহায়তা করেছেন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব জেনেভার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্যাবিয়েন কটিয়ের তথ্য বিশ্লেষণে অবদান রেখেছেন। সিজেআই–এর ফেলো হিসেবে জাজমিন জিওয়া কার্লা মান্দিওলা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। বাংলায় অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ও শেখ নিয়ামত উল্লাহ

গ্রিসেলদাকে জীবনে বড় সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছিল ২০১৮ সালে। তাঁর বাড়ি ছিল গুয়াতেমালার কুয়েতজালতেনাঙ্গো শহরের কাছে এক পাহাড়ি এলাকায়। বছরের পর বছর ধরে মাটির ঘরে বৃষ্টির পানি ঢোকা ঠেকাতে পারেননি তিনি। গ্রিসেলদার দুর্দশা আরও বাড়িয়েছিল খরা। ফলে ২০১৮ সালে জন্মভূমি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

হোসেনের বসবাস ছিল দুই মহাদেশ পেরিয়ে। তিনি বদলে যেতে থাকা জলবায়ুর চাপটা টের পেয়েছিলেন ২০২২ সালের গ্রীষ্মের শেষ দিকে। তখন তিনি স্ত্রী ও সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েকে বাড়ি ফেরানোর জন্য হাসপাতালের বিলটুকুও মেটাতে পারছিলেন না। বাংলাদেশের ফেনী জেলায় এক দশক ধরে বারবার বন্যায় তাঁর ফসল নষ্ট হয়েছিল। ফলে ফুরিয়ে গিয়েছিল সব সঞ্চয়।

মোহামেদের বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে আরও সম্প্রতি, ২০২৩ সালে সেনেগালের দিউরবেল এলাকায় নতুন করে আরেক দফা খরা ও তীব্র বৃষ্টিপাতের পর। এই দুর্যোগের জেরে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে তাঁর টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল।

দুর্যোগগুলোর কিছু এসেছিল হঠাৎ করেই, কিছু ধীরে ধীরে। আর শেষ পর্যন্ত জলবায়ু সংকট এই মানুষগুলোর পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচতে তখন যা সবচেয়ে ভালো মনে হয়েছিল, সেটাই করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। আর তা হলো, মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা। তারপর নিউইয়র্ক শহরে নতুন একটি জীবন খুঁজে নেওয়া।

প্রতীকী ছবি

পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে প্রচণ্ড গরম পড়ছে, দেখা দিচ্ছে খাবার আর পানির সংকট, বাড়ছে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে। এতে ঘন ঘন ভয়াবহ ঝড়, বন্যা ও খরা দেখা দিচ্ছে। এই দুর্যোগগুলো বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন বহু মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট এই উষ্ণতা বিশেষ করে পৃথিবীর মধ্যাঞ্চলকে ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম বাসযোগ্য করে তুলছে।

জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় এলাকায় উপকূলে বসবাস করা জনগোষ্ঠী প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শেষ পর্যন্ত যদি (জলবায়ু–সংক্রান্ত) সীমাবদ্ধতাগুলোর সমাধান করা না যায়, খাপ খাওয়ানোর জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয় এবং জলবায়ু–সংক্রান্ত বিপর্যয়গুলো তীব্র হতে থাকে; তাহলে এই এলাকাগুলো বসবাসের আরও অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।’

গুয়াতেমালা, বাংলাদেশ ও সেনেগালের মতো দেশগুলোয় যেসব এলাকা ২০১০ সাল থেকে বারবার ঝড়, বন্যা ও খরার কবলে পড়েছে, সেখান থেকে মানুষ অভিবাসন করছে। চরম আবহাওয়ার ফলে সৃষ্টি হওয়া এসব দুর্যোগ দেশগুলোর নড়বড়ে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আর তা মানুষকে সহ্যের শেষ সীমার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

খুব কম অভিবাসীই তাঁদের দুর্দশার জন্য উষ্ণ হয়ে ওঠা পৃথিবীকে দায়ী করেন। কিন্তু তাঁদের ভেঙে পড়া বাড়িঘর এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের মধ্যে এই উষ্ণতার প্রভাবটা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের অব্যাহত অভিবাসনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ু–সংক্রান্ত বিপর্যয়। কারণটা চট করে চোখে পড়ে না, কিন্তু সেটা নীরবে কাজ করে চলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ গোলার্ধের নিম্ন আয়ের দেশগুলো থেকে প্রায় ১৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হতে পারেন। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ অঞ্চলে।

প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন দেশের সরকার, ত্রাণ সংস্থা ও গবেষকেরা জলবায়ু–সংক্রান্ত অভিবাসন সংকট নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। তবে এ হুমকি আর দূরে নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনই এই সংকট চলছে। আর তা নিউইয়র্ক শহরেও পৌঁছে গেছে।

কলাম্বিয়া জার্নালিজম ইনভেস্টিগেশন (সিজেআই) ও ‘ডকুমেন্টেড’–এর এক বছর ধরে করা অনুসন্ধান বিশ্বজুড়ে একটি ধারা দেখতে পেয়েছে। তা হচ্ছে, ২০২৪ সালে মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা হাজার হাজার অভিবাসী এমন এলাকা থেকে এসেছেন, যে এলাকাগুলো বারবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার কবলে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ–পশ্চিম সীমান্ত থেকে আটক করা অভিবাসীদের নিয়ে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য এবং বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক তথ্যের বিশ্লেষণ তেমনটাই বলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে অভিবাসীদের যাত্রার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা বোঝার জন্য ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের (সিবিপি) হাতে আটক ব্যক্তিদের ৯০ লাখের বেশি নথি বিশ্লেষণ করে দেখেছে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড। নথিগুলোয় তাঁদের জন্মশহর, নগর ও পৌর এলাকার তথ্যও ছিল।

পাবলিক নথি পাওয়ার আবেদন করে সিবিপির তথ্য–উপাত্তগুলো সংগ্রহ করেছিলেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এবং সিজেআই। সিজেআই ও ডকুমেন্টেড দেখতে পেয়েছে যে শুধু ২০২৪ সালেই আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৫২০ জনের বেশির জন্মস্থান গুয়াতেমালায়। প্রায় ৩৫০ জনের জন্ম হয়েছে সেনেগালে, আর ১০০ জনের মতো বাংলাদেশে।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫৫টির মতো দেশ থেকে গড়ের চেয়ে বেশি হারে অভিবাসন হয়েছে। ইএম-ডিএটি নামে পরিচিত দুর্যোগ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক একটি তথ্যভান্ডার বলছে, এই দেশগুলো ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি বা তার বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়েছে। দুর্যোগের বড় বড় ঘটনা নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা ও অন্যান্য সরকারি সূত্রের প্রকাশিত তথ্য নিয়ে কাজ করে ইএম-ডিএটি।

তবে এই উপাত্তে ফাঁক রয়েছে। একজন মানুষ কেন নিজের দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, এসব তথ্য–পরিসংখ্যান তা বলতে পারে না। এ ছাড়া অত্যধিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির মতো আবহাওয়ায় যেসব পরিবর্তন ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে এসেছে, সেগুলোর কথা এতে ধরা পড়ে না। এই পরিবর্তনগুলো বড় বড় বিপর্যয়ের চেয়ে কম প্রবল হলেও এগুলোর বড় প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে নিজ দেশ ছেড়েছেন—এমন অভিবাসীদের খুঁজে বের করতে এই তথ্যগুলো ব্যবহার করেছে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড।

এ তালিকায় রয়েছে কুয়েতজালতেনাঙ্গো, ফেনী ও দিউরবেলের মতো শহর ও নগর। নিউইয়র্কে নতুন ঠিকানা তৈরি করতে সাম্প্রতিক সময়ে এলাকাগুলো ছেড়েছেন অভিবাসীরা। নিউইয়র্কের বিভিন্ন ক্যাফে, খাদ্য বিতরণকেন্দ্র এবং জনসমাগমের জায়গায় বহু অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড।

ওই অভিবাসীরা বলেছেন, নিজ দেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার প্রভাব দিনে দিনে আরও খারাপ হতে থাকায় এখানে চলে এসেছেন তাঁরা। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে নিউইয়র্ক শহরে যে ২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সেই দলে পড়ে। এর ফলে শহরের আশ্রয়ণব্যবস্থার ওপর চাপ পড়ছে। জরুরিভাবে তাঁদের থাকতে দেওয়ার জন্য স্থানীয় হোটেল ও বড় তাঁবু ব্যবহার করতে হচ্ছে।

নিউইয়র্কে পৌঁছানোর পর অভিবাসীরা শহরের পাঁচটি বরো বা প্রশাসনিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছেন। প্রায়ই তাঁদের শেষ ঠিকানা হচ্ছে নিজ দেশের অভিবাসীদের বসতিগুলোয়। নিউইয়র্কে বসবাস করা মধ্য আমেরিকান অভিবাসীদের মধ্যে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে আছে গুয়াতেমালার বাসিন্দারা। দেশটির পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে এসেছেন তাঁরা। বারবার ঝড়ের আঘাত এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা খরায় ওই এলাকাগুলোয় জীবন–জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে।

নিউইয়র্কের ব্রংক্সের স্থানীয় মসজিদগুলোয় নামাজ পড়তে আসেন সেনেগালের অভিবাসীরা। সেখানে জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অন্যান্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁদের। সেনেগালের অভিবাসীদের বেশির ভাগই এসেছেন দেশটির পশ্চিমাঞ্চল থেকে। সেখানে তাপমাত্রা বাড়ছে, কমছে বৃষ্টিপাত। ফলে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ফসল—বাদামের চাষাবাদ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এশিয়া থেকে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীরা প্রথমে ব্রুকলিনের কেনসিংটন এলাকায় বাংলাদেশি মুদিদোকান ও রেস্তোরাঁগুলো ঘিরে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের বেশির ভাগই আসেন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার পানি বেড়ে এ এলাকাগুলো বন্যার কবলে পড়ে থাকে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব লর সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড রিফিউজি স্টাডিজ বিভাগের পলিসি ও অ্যাডভোকেসিবিষয়ক সহযোগী পরিচালক ফেলিপ নাভারো বলেন, কারও অভিবাসনের সিদ্ধান্তের পেছনে সাধারণত একক কোনো কারণ থাকে না। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেখা দেওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো কীভাবে তাঁদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে পারে, তা বোঝাটা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ নাভারো বলেন, ‘শুধু একটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে—ব্যাপারটা এত সরল নয়। বরং বিষয়টি হলো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং রাষ্ট্র কীভাবে এর মোকাবিলা করেছে।’

বিগত বছরগুলোয় যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ–পশ্চিম সীমান্তে এসেছেন, তাঁদের আশা ছিল দেশটিতে আশ্রয় পাবেন। তবে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের সুরক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। ফলে অভিবাসন নিয়ে তাঁদের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীদের গ্রেপ্তার, আটক ও নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর অভিযান জোরদার করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার কারণে বাস্তুচ্যুত অভিবাসীরা আবার জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এলাকাগুলোয় ফিরে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।

অভিবাসী এই মানুষগুলোর জীবনের গল্প তুলে ধরা হলো—

কুয়েতজালতেনাঙ্গো, গুয়াতেমালা

গ্রিসেলদার মনে আছে, তাঁদের বাড়ির দেয়ালের ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকত। রান্নাঘরের ছাদ চুইয়েও পড়ত পানি। গুয়াতেমালার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কুয়েতজালতেনাঙ্গোতে আশপাশের অনেক বাড়ির মতো, তাঁদের বাড়িটি ছিল মাটির তৈরি। ২০১০ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আগাথা’ আঘাত হানলে বৃষ্টির পানিতে বাড়িটির দেয়ালে গর্ত হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বাড়িটি আর টিকে থাকতে পারেনি। পরবর্তী বছরগুলোয় আঘাত হানা সাতটি বড় সাইক্লোন, বন্যা ও হারিকেনের শুরুটা হয়েছিল এই ঘূর্ণিঝড় আগাথা দিয়ে।

নিউইয়র্কের ইস্ট হারলেম এলাকায় এক ফাঁকা ক্যাফেতে বসে স্প্যানিশ ভাষায় নিজের কথা বলছিলেন গ্রিসেলদা। তিনি বলেন, ‘ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। খুবই ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল।’

ছোটবেলায় গ্রিসেলদার জীবনটা কাটত তাঁর পরিবারের চাষাবাদ করা ফসল ঘিরে। ভুট্টা, শিম, আলু ও আপেল চাষ করতেন তাঁরা। তাঁর গ্রামে ফসল চাষাবাদের সময়পর্বটা যে বদলে যাচ্ছে, তা ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার সময়টা বারবার বদলাচ্ছিল। আর বর্ষাকাল একবার এলে, তুমুল বর্ষণ হচ্ছিল। যেমন বলা চলে আগাথার কথাই। এই বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলি জমি তলিয়ে যেত, নষ্ট হতো ফসল। এর পাশাপাশি বারবার খরাও দেখা দিচ্ছিল। সব মিলিয়ে গ্রিসেলদার পরিবারের জমিগুলোয় ফলন কমে এসেছিল।

গ্রিসেলদার আত্মীয়স্বজন এখনো গুয়াতেমালায় তাঁদের গ্রামে বসবাস করেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি যদি দেরিতে আসে, তাহলে ফসল ঠিকমতো বেড়ে উঠতে না–ও পারে। হয়তো শতভাগ ফসল পাওয়া যাবে না, হয়তো ৫০ শতাংশ পাওয়া যাবে। আর বৃষ্টি শুরু হতে হতে মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার মানে হলো পুরো বছরের চাষাবাদই বিফলে যাওয়া।

গ্রিসেলদারের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি মিলে যায় মধ্য আমেরিকায়—বিশেষ করে গুয়াতেমালায় জলবায়ু গবেষকেরা যা দেখেছেন, তার সঙ্গে। অভিবাসীদের নিজ ঠিকানা ছেড়ে আরও উত্তরে মেক্সিকো–যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের দিকে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে জলবায়ু–সংক্রান্ত দুর্যোগগুলো। ডিউক ইউনিভার্সিটিতে জলবায়ু, জলবায়ু খাপ খাওয়ানো ও অভিবাসনবিষয়ক একটি প্রকল্প পরিচালনায় সহায়তা করছেন সারা বারমিও। তাঁর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা ও ঝড় আরও তীব্র হচ্ছে। চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর জন্য এই দুই দুর্যোগ একসঙ্গে মিলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

বারমিও বলেন, কিছু পরিবারের হয়তো নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার এবং অন্য কোথাও অভিবাসন করার জন্য অর্থকড়ি রয়েছে। তবে অন্যদের দেশে থেকে যেতে হয়। আর তারা ‘ফাঁদে আটকা পড়েন’। বারমিওর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের খরার সময় মধ্য আমেরিকার গ্রামাঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করা পরিবারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছিল।

আরও সাম্প্রতিক সময়ে করা আরেক গবেষণায় মেক্সিকোর গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদের মৌসুমে দেখা দেওয়া তীব্র খরার সঙ্গে অবৈধ অভিবাসনের উচ্চহারকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে মানুষ অভিবাসনের পর নিজ দেশে ফেরার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

তরুণ বয়সে গ্রিসেলদা দেখেছিলেন যে খরা দিন দিন আরও খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন ট্রাকে করে পানি আনা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না তাঁদের। বাকি দিনগুলোয় গ্রিসেলদাকে নদীতে গিয়ে পানি আনতে হতো। তিনি বলেন, ‘খুব বেশি বৃষ্টি হতো না। আর ঝড় আঘাত হানলে নদীর পানি নোংরা হয়ে যেত। ফলে পরিষ্কার পানি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ত।’

এই ঘূর্ণিঝড় আর ভারী বৃষ্টিপাত দেখা দিত খরার মধ্যেই। ভাসিয়ে নিত গ্রামকে। এতে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত। বাধা আসত ফলনে। গ্রিসেলদার মনে পড়ে, তাঁর শ্বশুরবাড়ির কাদামাটির ঘরের কথা। বৃষ্টির পানি দেয়াল ভেদ করে ঘরের ভেতরে চলে আসত। শুষ্ক আবহাওয়া যত দীর্ঘ সময় ধরে থাকছিল, বৃষ্টিপাতও তত তীব্র হচ্ছিল। ফলে কঠিন হয়ে পড়েছিল তাঁদের জীবন।

কয়েকবার বন্যার কবলে পড়ে ২০১৩ সালের দিকে গ্রিসেলদার স্বামী দেশ ছেড়ে নিউইয়র্ক শহরে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে তিনি রেস্তোরাঁয় রান্না ও ধোয়ামোছার কাজ করতেন। সে সময় দুই সন্তানকে নিয়ে দেশেই ছিলেন গ্রিসেলদা। তিনি দেখেছিলেন, প্রতিবার ঝড়ের পর শ্বশুরবাড়ির ঘরটি আরও নড়বড়ে হয়ে উঠছে। ২০১৮ সালের মে মাসে কুয়েতজালতেনাঙ্গো শহরসহ গুয়াতেমালার অনেক এলাকা বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর দেখা দেওয়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাস্তাঘাট। জরুরি সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখে শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল গ্রিসেলদাকে। বাবার জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেন তিনি। এরপর এক দালালের সহায়তায় দুই সন্তান নিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন। পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্র–মেক্সিকো সীমান্তে। টেক্সাসে পৌঁছানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তারা তাঁর কাছে সন্তানদের জন্মসনদ চান। তারপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় অভিবাসীদের আশ্রয়কেন্দ্রে। পরে তাঁর স্বামী তাঁদের জন্য নিউইয়র্কে যাওয়ার বাসের টিকিট পাঠান।

দুই বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে ইটা ও ইয়োটা ঘূর্ণিঝড় গুয়াতেমালায় আঘাত হানে। এতে বছরের পর বছর ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, ভেসে যায় ফসলি জমি। বিগত কয়েক বছরে দেশের পশ্চিমে পাহাড়ি অঞ্চলে কুয়েতজালতেনাঙ্গোর মতো এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। এমন নয় যে সব ক্ষেত্রে জলবায়ু–সংক্রান্ত একটি দুর্যোগের পর তারা দেশ ছেড়েছে, বরং এর পেছনে কাজ করেছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা দুর্গতি। সিজেআই ও ডকুমেন্টেডের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গুয়াতেমালা থেকে অভিবাসন সামগ্রিকভাবে কমেছে। তবে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।

গ্রিসেলদা নিউইয়র্ক শহরে আসার পর সাত বছর কেটে গেছে। তিনি এখন শহরের ইস্ট হারলেম এলাকায় দুই কক্ষের একটি অ্যাপার্টমেন্টে চার সন্তানকে লালন–পালন করছেন। গ্রিসেলদা বলেন, তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন। তবে এ কাজে সহায়তা করা ব্যক্তিদের একজন তাঁর কাছ থেকে কয়েক হাজার ডলার আত্মসাৎ করেছিলেন। পরে নতুন করে চেষ্টা চালানোর জন্য এই ব্যবস্থার ওপর আর ভরসা করে উঠতে পারেননি তিনি।

এখন গ্রিসেলদার কাছে একটি লাল রঙের কার্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। এই কার্ডটি তাঁর কর্মস্থল থেকে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হলে কী করতে হবে, তার বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে তাতে। গ্রিসেলদা বলেন, ‘আমি আর নিজ দেশে ফিরতে চাই না।’

প্রতীকী ছবি

ফেনী, বাংলাদেশ

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে হোসেনের স্ত্রী সুমাইয়া কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। চার বছর আগে এক সন্তান হারানোর পর এই দম্পতি আশা করেছিলেন, তাঁদের জীবন নতুন করে শুরু হবে। তবে স্ত্রী ও সদ্যোজাত সন্তানকে ফেনীর হাসপাতাল থেকে নিতে গেলে হোসেনের হাতে ৪৭০ ডলারের (প্রায় সাড়ে ৫৭ হাজার টাকা) একটি বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। সিজরিয়ান অস্ত্রোপচারের খরচা বাবদ ওই বিল পরিশোধের সামর্থ্য ছিল না তাঁর।

এক দশকের মধ্যে পাঁচবার বন্যার কবলে পড়ে এই দম্পতির বাড়ি। আশপাশের ধানি জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফসল তুলতে না পেরে কমে এসেছিল তাঁদের আয়-উপার্জন। সদ্যোজাত সন্তানকে বাড়িতে আনার জন্য হোসেনকে আত্মীয়স্বজন ও এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়েছিল।

দক্ষিণ–পূর্ব বাংলাদেশের এই অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা গ্রাম। অঞ্চলটিতে তিনটি নদী এসে মিলেছে। সেখানে অন্যদের মতো হোসেনও নিজের জমিতে ধান চাষ করতেন। সেই ধান স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন। তবে প্রতিবার বন্যায় তাঁর জমি মাসের পর মাস পানিতে তলিয়ে থাকত। কয়েক বছর ধরে নিজের মোট জমির তিন ভাগের এক ভাগে চাষাবাদ করতে পেরেছিলেন তিনি। ফলে পরিবারের জন্য খাবার ও চিকিৎসার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাঁকে।

ফেনীর ১৬ লাখ বাসিন্দার অনেকে হয় কৃষিজমি বা খামারের মালিক অথবা সেখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। অন্যরা মাছ ধরেন বা পাট ও মাটি দিয়ে হস্তশিল্প তৈরি করেন। ইএম-ডিএটি-এর দুর্যোগ-সংক্রান্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত ১০ বছরে ফেনী ও আশপাশের এলাকায় বন্যায় প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ ও দুর্যোগবিশেষজ্ঞ সানজিদা মুর্শেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় গত দুই দশকে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, এর ফলে ফেনীর মতো উপকূলীয় এলাকায় খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে। কারণ, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এতে ধান উৎপাদন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

সিজেআই ও ডকুমেন্টেড–এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে উপকূলীয় এলাকা থেকে বেশি মানুষ অভিবাসন করে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে গেছেন। বাংলাদেশি অভিবাসীরা যেসব জেলা থেকে গেছেন, সে তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নোয়াখালী। এর অদূরেই ফেনী। সীমান্তে আটক বাংলাদেশিদের নথি অনুযায়ী, অভিবাসীদের আদি নিবাসের শীর্ষে আছে নোয়াখালী—৩০ শতাংশের বেশি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত যেমনটা ঘটে, ঠিক তেমনই ফেনীর অনেক পরিবারের প্রথম গন্তব্য ছিল দেশের রাজধানী ঢাকা। সেখানে জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেশি। হোসেন দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। দেশে পরিবর্তন আনার জন্য বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি বলেন, রাজনীতিতে জড়ানোর কারণে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা তাঁকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে বন্যার কারণে তাঁর ফসল নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

ফেনীতে হোসেনের বন্যাকবলিত এলাকা

হোসেন বলেন, ‘আমি সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকতাম। কোনো কাজকর্ম ঠিকভাবে করতে পারতাম না।’ পরে তিনি জানতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকে আশ্রয় পাচ্ছেন। তাঁর এক বন্ধু পরামর্শ দেন যে তিনি ব্রুকলিনে যেতে পারেন। কারণ, সেখানে বাংলাদেশিদের বড় একটি বসতি আছে।

হোসেন তাঁর জায়গাজমি বিক্রি করে দেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেন প্রায় ৩৩ হাজার ডলার। এভাবে তিনি যাত্রাখরচ ও দালালের খরচ বাবদ ৪১ হাজার ডলার জোগাড় করেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ছাড়েন হোসেন। আকাশ ও স্থলপথে ৯ মাস ধরে ১১টি দেশ পাড়ি দেন তিনি। তারপর গিয়ে অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের সীমান্ত কর্মকর্তাদের কাছে ধরা দেন। তাঁরা তিন দিন তাঁকে ১৫ জনের সঙ্গে একটি ঘরে আটক করে রাখেন। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। এই শহরটিতে আনুমানিক ১ লাখ বাংলাদেশির বসবাস।

তত দিনে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে ভিড় করছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে। আর তাঁরা অভিবাসন আদালতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

সিজেআই এবং ডকুমেন্টেডের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পারাপারের ঘটনা ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। দুর্যোগপ্রবণ চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত ফেনী শহরটি সেই শীর্ষ ১০টি বাংলাদেশি শহরের মধ্যে রয়েছে, যেসব শহর থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে পৌঁছেছেন।

নিউইয়র্ক সিটির একটি কমিউনিটি সংস্থা ‘দেশিজ রাইজিং আপ অ্যান্ড মুভিং (ড্রাম)’–এর সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, সদ্য আগত ১৩৫ জন বাংলাদেশি ও অন্যান্য অভিবাসী জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে নিজ নিজ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের এপ্রিলে ম্যানহাটানের একটি আইনি সংস্থা হোসেনের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন দাখিল করে। তাঁর এই আবেদনের ভিত্তি ছিল তিনি বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক। আশ্রয়ের আবেদনের কারণ হিসেবে তাঁর আয় ও জীবিকার ওপর জলবায়ুজনিত বন্যা পরিস্থিতির প্রভাব আমলযোগ্য নয়।

কাজের ভারে জর্জর অভিবাসন আদালতে মামলার শুনানির জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় সাত মাস পর হোসেন একটি ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতিপত্র) পান। প্রথম দিকে তিনি একটি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় ‘কিচেন হেলপার (রান্নার কাজে সহকারী)’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ব্রুকলিনের রাস্তায় বাইকে করে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজ নেন। বর্তমানে তিনি ব্রুকলিনের কেনসিংটনে ‘লিটল বাংলাদেশ’ হিসেবে পরিচিত এলাকায় একটি বাঙালি মিষ্টির দোকান ও ক্যাফেতে পূর্ণকালীন কাজ করেন। তিনি কাছাকাছি একটি বেজমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে দুজন রুমমেটের সঙ্গে থাকেন। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করেন; ধর্মীয় উৎসবগুলোর সময় সাত দিনও কাজ করে থাকেন।

গত বছর তিন দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা তাঁর নিজ শহর ফেনীকে গ্রাস করে, যেখানে তখনো তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে থাকতেন। এ বন্যায় তাঁদের পারিবারিক বাড়ি তিন ফুট পানির নিচে ডুবে যায়। এর সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে পয়োনিষ্কাশনের নোংরা পানি, সাপ–ব্যাঙ। বন্যায় তিনটি খাট, এক সেট সোফা, চেয়ারসহ তাঁদের ঘরের প্রায় সব আসবাব নষ্ট হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে প্রায় ১০০ মাইল (১৬০ কিলোমিটার) দূরে ঢাকার এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যেতে হয়।

হোসেন আশা করেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তিনি বলেন, যদি তিনি জানতেন যে বর্তমানে এটি এতটা কঠিন, তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসতেন না। ফেনীতে তিনি যা কিছু হারিয়েছেন, এখন সেখানে একটি নতুন বাড়ি তৈরি করতে তাঁর প্রায় ৪৫ হাজার ডলার (প্রায় ৫৫ লাখ টাকা) খরচ হবে বলে ধারণা করছেন।

দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি ব্রুকলিনের বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। নিউইয়র্কের বাফেলোতে কর্মরত নোয়াখালীর দুই বাংলাদেশিকে যখন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) সদস্যরা আটক করেন, সেই খবর দ্রুত কেনসিংটন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন আগেও এই এলাকার ‘নোয়াখালী দেশি বাজার’ পরিবারগুলোর ক্রেতাদের ভিড়ে জমজমাট থাকত। ‘রাজ মহল রেস্টুরেন্ট + সুইটস’-এর মতো ভোজনালয়গুলোতে পুরুষেরা ভিড় করতেন। কিন্তু বর্তমানে সেখানকার রাস্তাঘাট যেন সুনসান হয়ে গেছে।

হোসেনের মনে এই বিশ্বাস ছিল, তিনি এখানে এসে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবেন। সেই বিশ্বাস এখন ফিকে হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আতঙ্কে থাকি।’ তিনি তাঁর আশ্রয় আবেদনের অনুলিপি এবং আদালতের শুনানির নোটিশগুলো শোবারঘরের ড্রয়ারে একটি প্লাস্টিকের ফোল্ডারে সব সময় হাতের কাছে রাখেন। যদি কখনো আইসিই সদস্যরা বাসায় হানা দেন, সেই আশঙ্কায় তিনি তাঁর আইনজীবীর নম্বর মুঠোফোনের স্পিড ডায়ালে রেখেছেন।

হোসেনের কণ্ঠে হতাশা, ‘যদি আমাকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তবে আমি জানি না কীভাবে আমার পরিবারকে খাওয়াব। এখন বন্যায় আমার ঘরও হারিয়ে গেছে। আমার ফিরে যাওয়ার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নেই।’

দিউরবেল, সেনেগাল

সাউথ ব্রংক্সের একটি মসজিদে জুমার নামাজের আগে কার্পেটের ওপর আড়াআড়িভাবে পা রেখে বসেছিলেন মোহামেদ। অতীত স্মৃতিতে ডুবে তিনি সযত্নে মনে করছিলেন নিজের ফসলের কথা। সেনেগালের দিউরবেলে পারিবারিক খামারে তিনি ভুট্টা, তরমুজ ও বাদাম চাষ করতেন। এ ছাড়া প্রায় ৪০ মাইল দূরের কাওলাকের আরেকটি খামারে তিনি মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।

মোহামেদের পাশে বসেছিলেন প্রায় ৪০ জন পশ্চিম আফ্রিকার অভিবাসী, যাঁদের অনেকেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনেগাল থেকে নিউইয়র্কে এসেছেন। হাত তুলে দেখানোর পর বোঝা গেল, তাঁদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কৃষক। তাঁরা নিজেদের দেশে বন্যা ও খরার শিকার হয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের একই ধরনের চক্রের শিকার হয়েছেন তাঁরা, যা পাঁচ হাজার মাইল দূরে গুয়াতেমালায় গ্রিসেলদা ও তাঁর পরিবারকেও প্রভাবিত করেছে।

মোহামেদ ২০০৫ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর দাদার কাছ থেকে জমি পেয়েছিলেন। ৪৫ বছর বয়সী মোহামেদ বলেন, ‘যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তখন সবাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কারণ, এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি, চলছিল খরা।’

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সেনেগালের দিউরবেল, কাওলাক এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো বারবার বন্যা ও খরার এ চক্রের মুখোমুখি হয়েছে। সিজেআই ও ডকুমেন্টেড–এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২০ সালে ছয়টিরও বেশি বড় ধরনের বন্যা আঘাত হানার পরই সেনেগালের পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে। বছরের পর বছর জলবায়ুজনিত ঘটনাগুলোর প্রভাব জমতে থাকায় ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই অঞ্চলগুলো থেকে ১ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি সেনেগালি অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্র–মেক্সিকো সীমান্ত পার হয়েছেন, যা আগে কার্যত ছিল শূন্যের কোঠায়।

বন্যা যখন মোহামেদের নিজ শহর দিউরবেলে আঘাত হানে, তখন তাঁর জমিতে মাসের পর মাস পানি জমে ছিল। সেই পানি সবুজ হয়ে মশা-মাছির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়। তাঁর পরিবার বাইরে সময় কাটাতে পারত না। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের ঘরে প্রবেশের সুবিধার্থে মোহামেদকে ইট বিছিয়ে রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিল।

এরপর মোহামেদ ওই এলাকার ঐতিহ্যবাহী শস্য বাদাম চাষের পরিবর্তে ভুট্টা চাষের সিদ্ধান্ত নেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে গভীর জ্ঞান না থাকায় মোহামেদ ভেবেছিলেন, ভুট্টা ৫ থেকে ১২ ফুট লম্বা হয়, তাই এটি হয়তো বিরূপ আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ভুট্টার গাছই শুকিয়ে মরে যায়। তিনি বলেন, ‘জমিটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে গিয়েছিল।’

দীর্ঘমেয়াদি অতিবৃষ্টি এবং লাগাতার খরা শেষ পর্যন্ত মোহামেদের আত্মীয়দের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়িয়ে তোলে। তাঁরা একই পারিবারিক বাড়িতে আলাদা ঘরে বসবাস করতেন। মোহামেদের ভাই শিক্ষকতা করে তুলনামূলক বেশি উপার্জন করতেন। তিনি বালু, নুড়ি ও সিমেন্ট দিয়ে ৬ ফুট ভিত্তি (ফাউন্ডেশন) দিয়ে একটি নতুন বাড়ি করেন। যখন বন্যা হতো, তখন পানি তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করত না। অথচ মোহামেদকে বালতি ভর্তি করে পানি তাঁর ঘর থেকে বাইরে ফেলতে হতো এবং তোয়ালে দিয়ে মেঝে মুছতে হতো।

মোহামেদের ২ থেকে ১৩ বছর বয়সী ছয় সন্তানকে তাদের জীর্ণ ঘরটির জন্য প্রায়ই অন্যদের কাছ থেকে কটুকথা শুনতে হতো। স্কুল, কর্মক্ষেত্র এবং বাড়িতে এ ধরনের উপহাস ও বিদ্রূপ পরিবারটিকে তাড়িয়ে বেড়াত এবং তাঁরা একা বোধ করত।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৈশ্বিক অভিযোজন ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির সাবেক পরিচালক (সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৫) ডিনা এসপোসিটো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চাপ সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তিনি বলেন, ‘যখন জলবায়ুজনিত চাপ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে, তখন পরিবার বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।’

সেনেগালের দিউরবেলে নিজের বাড়িতে বসে মোহামেদ যখন টেলিভিশনে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের দৃশ্য দেখতেন, তখন তিনি ঝলমলে আলো দেখে মুগ্ধ হতেন আর বিশাল ডিজিটাল পর্দা দেখে অবাক হয়ে যেতেন।

মানব পাচারকারীরা প্রায়ই নিজেদের ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামে বিভিন্ন ভিডিও তৈরি করতেন। এসব ভিডিওতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর যাত্রাটিকে অত্যন্ত আরামদায়ক বলে প্রচার করা হতো। সেনেগাল অঞ্চলে বহুল প্রচলিত ওলোফ ভাষায় কথা বলে তাঁরা দর্শকদের বলতেন, যুক্তরাষ্ট্রে কাজের অনুমতিপত্র (ওয়ার্ক পারমিট) এবং চাকরি পাওয়া খুবই সহজ।

নিকারাগুয়া হয়ে কীভাবে অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছেন, সেই সংক্রান্ত রিল বা ছোট ভিডিওগুলো মোহামেদ দেখতেন। এক বন্ধু তাঁকে একজন পাচারকারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই পাচারকারী লোকজনকে ভিসা ও উড়োজাহাজের টিকিট পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিতেন এবং পথে তাঁদের অন্য পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। মোহামেদ বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমি একবার যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে পারলে, “আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ তোমাকে বিতাড়িত করতে পারবে না”।’

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে মোহামেদ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ডলারে (প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা) একটি ঘোড়া, কয়েকটি গরু এবং একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি বিক্রি করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আসার জন্য তিনি আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ডলারেরও (প্রায় ১২ লাখ ২১ হাজার টাকা) বেশি খরচ করেন। তিনি অ্যারিজোনায় সীমান্ত টহল বাহিনীর সদস্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা তাঁকে এক রাত আটক রাখার পর মুক্তি দেন।

নিউইয়র্ক সিটিতে এসে সেই ঝলমলে ভিডিওতে দেখা জগতের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হন মোহামেদ। তিনি টাইমস স্কয়ারের কাছে একটি অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রক্রিয়াটি বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি জানান, তাঁর ধারণা ছিল না যে খরা ও বন্যার মতো জলবায়ু বিপর্যয় তাঁর আবেদনে খুব কম গুরুত্ব পাবে। যদিও তিনি আবেদনে তাঁর জীবন-জীবিকা নষ্ট করে দেওয়া জলবায়ু বিপর্যয়কেই অভিবাসনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

অভিবাসন দপ্তর ও আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে যাতায়াতের সময় মোহামেদ খুব কমই নিউইয়র্কের সেই ঝলমলে দৃশ্য উপভোগ করতেন। বরং তিনি এমন গৃহহীন মানুষদের দেখতেন, যাঁরা হাতে ‘আশা হারিয়েছি’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে সাহায্য চাইছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে যত বেশি সময় কাটাচ্ছি, তত বেশি বুঝতে পারছি যে বাস্তবতা ভিন্ন।’

মোহামেদ জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে আসার এক মাসের মধ্যেই তাঁকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। অন্য একজন অভিবাসী অভিযোগ করেছিলেন, তিনি নারীদের শৌচাগারে প্রবেশ করেছিলেন। যদিও মোহামেদ বলেছিলেন, তিনি শৌচাগারটিতে ভুল করে প্রবেশ করেছিলেন। কারণ, শৌচাগারের দরজায় থাকা সংকেত তিনি পড়তে পারেননি। জানতে চাইলে আশ্রয়কেন্দ্রের একজন মুখপাত্র এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আশ্রয় হারিয়ে মোহামেদ তখন ‘টু ট্রেন (পাতাল রেল)’–এ রাত কাটাতে শুরু করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে অন্য সেনেগালি লোকজনের দেখা হয়। এদের অনেকেই এখানকার মসজিদের ইমামদের যোগাযোগের নম্বর নিয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে এসেছিলেন। এই ইমামেরা এখানকার মসজিদের নেতৃত্ব দেন, যেমন অনেকটা সেনেগালের মসজিদে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা দিতেন। সেনেগালি লোকজনই মোহামেদকে ব্রংক্সের ওই মসজিদে সাহায্য চাইতে পরামর্শ দেন। সেখানে গিয়ে তিনি দিউরবেল ও কাওলাকের অন্য কৃষকদের বন্ধু হিসেবে পান।

মোহামেদ বলেন, ‘আমরা কথা বলতাম যে আমাদের পরিবারের সদস্যরা বৃষ্টি এবং এর সঙ্গে বন্যা আসা নিয়ে কীভাবে দুশ্চিন্তা করছে।’ তিনি একটি জায়নামাজে বসে কোরআন শরিফের আয়াত পাঠ করে প্রশান্তি খোঁজেন। এটি তাঁকে তাঁর প্রয়াত বাবার, যিনি একজন ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন, কথা মনে করিয়ে দেয়।

মোহামেদের নতুন বন্ধুদের মধ্যে একজন ওমর। তিনি গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন (ডেলিভারি ড্রাইভার)। তিনি মসজিদে খাবার নিয়ে আসতেন মোহামেদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে। আরেক বন্ধু এনদিয়াগা স্থানীয় একটি ‘হোম ডিপো’র বাইরে তাঁর সঙ্গে অপেক্ষা করতেন, যদি কেউ টুকটাক কাজের জন্য তাঁদের ডাকে।

গত কয়েক মাসে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা কয়েক হাজার অভিবাসীকে যুক্ত করে অন্তত আধা ডজন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এই চ্যাট গ্রুপগুলো একরকম সহায়তা গোষ্ঠীর মতো কাজ করে। সদস্যরা এখানে চাকরি এবং ঘরভাড়ার তথ্য আদান-প্রদান করেন। কেউ কেউ আবার এর চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে তাঁদের স্বজাতিকে সাহায্য করেছেন। ব্রংক্সের ওই মসজিদের নেতা ইমাম শেখ তিদিয়ান এনদাও সেনেগালের কাওলাকের বাসিন্দা। তাঁর দাদা সেখানে একজন সুপরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত তাঁর মসজিদে এসে পরিচিত হওয়া অভিবাসীদের মধ্যে ৪০টি বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন।

সম্প্রতি এই কমিউনিটির মনোযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বিতাড়নের হুমকির দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। সিজেআই ও ডকুমেন্টেড–এর সঙ্গে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের ভয়েস নোট শেয়ার করেন এই ইমাম। সেখানে সদ্য অভিবাসন আদালত থেকে ফেরা এক অভিবাসী সতর্ক করে বলেছেন, অভিবাসীরা এ দেশে থাকতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রয়োজনীয় সব নথি জমা দিতে তাঁদের মাত্র দুই সপ্তাহ সময় দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের জন্য তৈরি হওয়া হুমকির খবর এখনো সেনেগালে পৌঁছায়নি। ইমাম এনদাও জানান, তিনি এখনো প্রতি মাসে সেনেগালের কৃষকদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য ১০টিরও বেশি ফোন কল পান। প্রায়ই তাঁরা তাঁকে জানান, এখন তাঁরা দিনে মাত্র এক বেলা খাবার জোগাড় করতে পারছেন। সেনেগালে কয়েক মাসে যে পরিমাণ তাঁরা উপার্জন করেন, যুক্তরাষ্ট্রে এক সপ্তাহে এর চেয়ে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন—এই প্রলোভনই তাঁদের আকৃষ্ট করছে।

ওই ইমাম বলেন, ‘তাঁরা এখনো আমেরিকা আসতে চান।’

৯০ লাখের বেশি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অভিবাসনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে প্রভাব ফেলছে, তা বোঝার জন্য প্রায় এক বছর ধরে ৯০ লাখের বেশি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে কলাম্বিয়া জার্নালিজম ইনভেস্টিগেশন (সিজেআই) ও ডকুমেন্টেড। ওই তথ্যগুলো ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে যত মানুষ আটক হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনের (সিবিপি) কাছ থেকে ওই তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও সিজেআইয়ের গবেষকেরা। এর মধ্যে রয়েছে আটক ব্যক্তিদের জন্মস্থানের তথ্যও। এটি সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ব্যক্তিদের জন্মস্থান নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্যের উৎস। তবে এই তথ্যে কিছু ঘাটতি রয়েছে। সীমান্তের আটক অভিবাসীদের জন্মস্থানের তথ্যগুলো নথিবদ্ধ করেছেন সিবিপির কর্মকর্তারা। তাঁরা সাধারণত অভিবাসীদের ভাষায় কথা বলতে পারেন না। আর যখন বিপুল পরিমাণে সীমান্ত পেরোনোর ঘটনা ঘটে, তখন তথ্যগুলো সব সময় নির্ভরযোগ্যভাবে নথিবদ্ধও করা হয় না। ১৯০টি দেশের ৪০ লাখের বেশি এলাকার নাম নথিবদ্ধ করেছে সিবিপি। এর মধ্যে অনেকগুলোর নাম ভুল বানানে লেখা হয়েছে, সংক্ষেপ করা হয়েছে বা একেবারেই ভুলভাবে লেখা হয়েছে। অনেক সময় শহরের জায়গায় প্রদেশের নাম লেখা হয়েছে। এই তথ্যগুলোর নথিতে ৩৫ শতাংশের মতো জায়গা জন্মস্থান লেখার ঘর খালি রাখা হয়েছে। আর ১ শতাংশের কম জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘জন্মস্থান জানা যায়নি’। আটক ব্যক্তিদের জন্মস্থান নিয়ে শহর ও রাজ্য পর্যায়ের তথ্য থাকার কারণে সিবিপির তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। এতে অভিবাসীরা কোথা থেকে এসেছেন, সে সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত এবং নির্ভরযোগ্য ভৌগোলিক তথ্য রয়েছে। তবে সিজেআই ও ডকুমেন্টেডের কাছে থাকা মোট অভিবাসীদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করতে চাওয়া সব অভিবাসীর তথ্যের চেয়ে কম। কারণ, এসব অভিবাসীর তথ্যের ভেতরে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ‘ইনঅ্যাডমিসেবল’ বা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে বিবেচনা করা হয়েছিল অথবা করোনা মহামারির সময় যাঁদের সঙ্গে ‘টাইটেল ৪২’ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেসব অভিবাসী ‘টেম্পোরারি প্রটেকটেড স্ট্যাটাস’ (টিপিএস) পাওয়ার যোগ্য, তাঁরা সাধারণত ইনঅ্যাডমিসেবল বা অগ্রহণযোগ্য শ্রেণিতে পড়েন। তবে এই বিশ্লেষণের মূলে থাকা তিন দেশ-গুয়াতেমালা, বাংলাদেশ ও সেনেগাল ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে টিপিএস পায়নি। ফলে টিপিএস পাওয়া অভিবাসীদের তথ্য বাদ দেওয়ার কারণে বিশ্লেষণের ফলাফলের ওপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। সীমাবদ্ধতাগুলো থাকার পরও সিজেআই ও ডকুমেন্টেড জলবায়ু এবং অভিবাসনবিষয়ক ৯ জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে। আর তাঁরা সবাই একমত হয়েছেন যে এগুলো বর্তমানে মার্কিন সরকারের কাছে থাকা সবচেয়ে ভালো তথ্য। জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো কীভাবে মধ্য আমেরিকায় অভিবাসনের গতিপ্রকৃতির ওপর প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে গবেষণার আগে মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, বেলিজ, কোস্টারিকা ও পানামার অভিবাসীদের নিয়ে সিবিপির সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্তগুলো সংশোধন করেছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফাবিয়ান কটিয়ের। অভিবাসীদের জন্মস্থানের তথ্যগুলো আরও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করেছেন তিনি। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভুল বানান সংশোধন করা হয়েছে, উচ্চারণগত ত্রুটির সমাধান করা হয়েছে এবং শহর ও রাজ্যের সঠিক নামের সঙ্গে অভিবাসীদের জন্মস্থান মেলানো হয়েছে। ত্রুটিমুক্ত তথ্য-উপাত্তগুলো সিজেআই ও ডকুমেন্টেডকে দিয়েছেন কটিয়ের। ‘জিও-কোডিং’ বা কোনো এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ের পদ্ধতি যাচাইয়ে সহায়তাও করেছেন তিনি। তথ্য ত্রুটিমুক্ত করার প্রক্রিয়াটি ১৮১টি দেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সহায়তা নিয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ তথ্য-উপাত্ত ত্রুটিমুক্ত করা গেছে। পরে সেগুলো আবার হাতেকলমে যাচাই করে দেখা হয়েছে। যেসব এলাকার নাম আদিবাসী ও স্থানীয় ভাষায়, সেগুলো শনাক্ত করতে বিভিন্ন কাস্টম ডিকশনারি বা বিশেষ শব্দতালিকা ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর সেগুলো যাচাই করার জন্য চালানো হয়েছে জিও-কোডিং বা ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ের পরীক্ষা। বিভ্রান্তি দেখা দেয় এমন বিষয়গুলো যেমন আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছের শহর বা একই নামের একাধিক এলাকার ক্ষেত্রে তথ্যগুলো হাতেকলমে যাচাই করেছে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড। প্রতিটি দেশ ধরে ধরে এলাকার নামের ভিন্নতাগুলো যাচাই করে তারা একটি চূড়ান্ত রূপ দিয়েছে। তথ্য পরিশোধনের পর সিজেআই ও ডকুমেন্টেড বিশ্লেষণ করেছে যে একটি দেশের কোন কোন এলাকার মানুষ ওই দেশে গড় অভিবাসনের চেয়ে বেশি হারে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত পেরোতে গেছেন। বড় শহরগুলো থেকে সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে। তাই কোন শহর থেকে কতজন অভিবাসন করেছেন, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি; বরং কোন শহরের অভিবাসীদের সীমান্তে আটক হওয়ার পরিমাণ কী হারে বেড়েছে বা শতকরা হারে কী পরিবর্তন এসেছে, তা দেখা হয়েছে। এই অভিবাসনের পেছনের কারণগুলো বুঝতে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড ২০১৯ ও ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে আটক হওয়া মানুষদের সংখ্যা তুলনা করেছে। ২০১৯ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার শেষ সময়। তখন সীমান্ত পেরোনোর ঘটনাগুলো প্রথম বৃদ্ধি পেয়েছিল। আর ২০২৪ সালে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন অভিবাসন রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছিল। ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংগ্রহ করা বড় পরিসরের তথ্যগুলো ব্যবহার করা হয়েছে অভিবাসনের দীর্ঘমেয়াদি ধারাগুলো শনাক্ত করার জন্য। বারবার ঘটে যাওয়া জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগগুলোর সঙ্গে অভিবাসীদের জন্মস্থানগুলোর একটি যোগসূত্র তৈরির জন্যও তথ্যগুলো কাজে লাগানো হয়েছে। অপরদিকে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের তুলনা সাম্প্রতিক সময়ে অভিবাসনের ধারাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সিবিপির তথ্যে শুধু অভিবাসীদের জন্মস্থান উল্লেখ থাকে। দেশটিতে তাঁরা শেষ কোথায় বসবাস করেছিলেন, তা উল্লেখ থাকে না। তাই সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের আগে তাঁরা নিজ দেশের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য কোনো স্থানে গিয়েছিলেন কি না, তা সিবিপির তথ্যে পাওয়া যায় না। অভিবাসীদের জন্মস্থান নিয়ে তালিকায় গুয়াতেমালার কুয়েতজালতেনাঙ্গো, বাংলাদেশের ফেনী ও সেনেগালের দিউরবেলের মতো জায়গা ছিল। চূড়ান্ত তালিকায় বাংলাদেশের মোট ১৫ টি, সেনেগালের ৯৬টি ও গুয়াতেমালার ৬৮৩টি এমন এলাকা তুলে ধরা হয়েছে। একই জায়গাগুলোর ওপর জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাব বোঝার জন্য সিজেআই ও ডকুমেন্টেড ইমার্জেন্সি ইভেন্টস ডেটাবেসের (ইএম-ডিএটি) সহায়তা নিয়েছে। বেলজিয়ামে দুর্যোগ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক এই তথ্যভান্ডার গড়ে তুলেছে সেন্টার ফর রিসার্চ অন দ্য এপিডেমিওলজি অব ডিজাস্টার্স (সিআরইডি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ২০১৯ থেকে ২০২৪ এবং ২০১০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সংগ্রহ করা তথ্যগুলো একত্র করে সিজেআই ও ডকুমেন্টেড ৮০ টির বেশি এলাকার একটি মানচিত্র তৈরি করেছে। এসব এলাকায় অভিবাসন এবং জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগ-দুটোই একসঙ্গে ঘটছে। এই মানচিত্র থেকে একটি লক্ষণীয় ধারা দেখা গেছে। তা হলো গত এক দশকে যে এলাকাগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ের চেয়ে বেশি অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছে, ওই সব এলাকার অনেকগুলোতেই বারবার ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, ঝড়, বন্যা ও খরা হয়েছে।