
যখন শুনলাম, ঢাকার কাছেই পূর্বাচল উপশহর–সংলগ্ন একটি গ্রামে একটি গাছ আছে, যার বয়স ৫০০ থেকে ৭০০ বছর, তখন থেকেই গাছটি দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিলাম। অবশেষে সেই সুযোগ এল। প্রকৃতিবন্ধু রুবাইয়াত রবিনের প্রস্তাবে হেমন্তের দ্বিতীয় দিনের দুপুরেই বেরিয়ে পড়লাম সেই গাছের সন্ধানে। বাসে গিয়ে দুজন নামলাম কুড়িল বিশ্বরোডে। এরপর একটি অটোরিকশা ধরে গেলাম লেংটার মাজার। সেখানে একটা ইজিবাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন চালক আকতার ভাই। তাঁকে ব্যাপারটা খোলাসা করে বলতেই তিনি আমাদের মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘আর বলতে হবে না। দেখেন, কোথায় আপনাদের কীভাবে নিয়ে যাই! শুধু ঘুরবেন আর ফটো তুলবেন, প্রাণভরে পূর্বাচলের ঠান্ডা হাওয়া খাবেন। একদম ফ্রি।’
সত্যিই তা–ই। ঢাকার এত কাছে পূর্বাচলের মতো একটি ক্রমবর্ধিষ্ণু শহরে গ্রামের আমেজ! ঢাকায় হেমন্তকে ঠাহর করতে না পারলেও এখানে এসে বুঝতে পারছি, বাংলায় হেমন্ত ঋতু এসে গেছে। আকতার ভাই ঠিক বুঝেছেন কি না, সন্দেহ হলো। তাই নিশ্চিত হতে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘অনেক প্রাচীন একটা গাছ, দেখেছেন কখনো?’ একগাল হেসে আকতার ভাই বললেন, ‘কী যে বলেন, আমার বাড়ি পূর্বাচলের দশ নম্বরে, এই সেক্টর হওয়ার আগে এই গ্রামেই আমার জন্ম। আর হিরনালের শিরনিগোটাগাছ চিনব না?’
আকতার ভাইয়ের মুখেই সে প্রাচীন বৃক্ষের নামটা প্রথম শুনলাম। এ জীবনে কত গাছের নাম যে শুনেছি! কিন্তু শিরনিগাছ নামে যে কোনো গাছ আছে, তা কখনো শুনিনি। তাই গাছটি দেখার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কতক্ষণে পৌঁছাব সেখানে কে জানে? পথে নানা রকমের বুনো ফুল, ঝোপঝাড়, আঁধারমাখা বাঁশবন-শালবন। সেসব ঝোপঝাড়ের মধ্য থেকে বুনো ফুলের ছবি, পোকামাকড়ের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলতে তুলতে বেলাটা পড়ে এল। আকতার ভাই আমাদের গাছপালার নেশা দেখে ছিনেজোঁকের মতো আমাদের সঙ্গে লেগে রইলেন, শিরনিগোটাগাছটা না দেখিয়ে কিছুতেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন না। সে গাছের কাছে একটা বিশাল বটগাছও নাকি আছে, যার কোনো গোড়া বা আদিগাছটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অবশেষে পড়ন্ত বেলায় পৌঁছালাম সেই হিরনাল গ্রামে। গাছের গোড়ায় নামতেই বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল! এত বড় কোনো গাছ হয়? এ দেশে এত দিন বটগাছকেই মানতাম মহীরুহ, এখন তো দেখছি এ গাছটাও কম না। গাছের বিশাল গুঁড়িটা কয়েকজন মিলে হাত ধরাধরি করেও বেড় পাওয়া যাবে না। অবাকবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলাম, এটাই কি সেই শিরনিগোটাগাছ? আকতার ভাই নিশ্চিত করলেন। আমিও তার ডালপাতা দেখে নিশ্চিত করলাম, ওটি খিরনিগাছ। স্থানীয় উচ্চারণে নামের বিবর্তন ঘটেছে, খিরনি হয়ে গেছে শিরনি।
গাছটির ইতিহাস ও সে সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওনারা অবশ্য আমার নামটাই সমর্থন করলেন। স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম ফকির (৫৫) বললেন, ‘এখন ফুল ফুটেছে। ফাগুন-চৈত্র মাসে গাছটা হলদে গোটা গোটা ফলে ভরে যায়। পাকা ফল তলায় পড়ে। ছেলেপুলেরা খুঁটে খায়। তবে আমরা কেউ গাছের পাতাটাও ছিঁড়ি না।’
ফজলুল হক ফকির (৬৫) বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছেন। বললেন, ‘গাছটার বয়স ৫০০-৭০০ বছর হবে হয়তো। মজার কথা কি জানেন? আমার বাবার মুখে শুনছি, গাছটা তাঁর বাবাও এ রকমই দেখেছেন, মুরব্বিদের কাছে যখনই যিনি শুনেছেন, বলেছেন শতবর্ষী গাছ। এভাবে কম করে হলেও পাঁচটা বংশের মুখে মুখে একই কথা শুনে এসেছেন তাঁর বংশের লোকেরা। তাতে অনুমান, গাছটার বয়স কম করে হলেও ৫০০ বছর তো হবেই। অনেক লোক এসে এ গাছের পাতা, ফুল, ফল নিয়ে যায়, মানত করে উপকার পেলে এখানে এসে শিরনি দিয়ে যায়। এ জন্য কেউ কেউ এ গাছের নাম দিয়েছে শিরনিগোটাগাছ, আসলে খিরনিগাছ।’ পাশেই একটি কাঠগোলাপের শতবর্ষী গাছও রয়েছে।
বাংলাদেশের আর কোথাও প্রাচীন কোনো খিরনিগাছ আছে বলে আমার জানা নেই। খিরনি, মহুয়া, সফেদা—এসবই একই গোত্রের গাছ। এদের পাতা, ফুল, ফল ও ডাল ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ বের হয়, যাকে বলে তরুক্ষীর বা ল্যাটেক্স। এ জন্য এ গাছ তিনটিকে ক্ষীরীবৃক্ষ বলে। খিরনিগাছের চারার ওপর সফেদার জোড়কলম করা হয়। কেননা সফেদার বীজ থেকে চারা করা হয় না। সেদিক থেকে গাছটি কলমের আদিজোড় বা রুটস্টকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খিরনির অন্য নাম খিরি, খিলুনি ও খিরখেজুর। ফল দেখতে হলদে রঙের পাকা খেজুরের মতো, ফুলের চেহারা বকুল ফুলের মতো। খিরনির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Manilkara hexandra ও গোত্র স্যাপোটেসি। গাছটির ঐতিহাসিক মূল্যও আছে। গাছটির গোড়া পাকা করে বাঁধিয়ে তাকে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করছে গ্রামবাসী। এ দেশে আর কোথায় কী কী শতবর্ষী গাছ আছে তার একটি তালিকা করে প্রকৃত বয়স নির্ণয় ও সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক