সাতসকালে রাজধানীতে এত বায়দূষণ একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আজ বৃহস্পতিবার সকালের কথা বলছি। কারণ, গতকাল বুধবার দিনের বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টি হয়েছে।
আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী ২৫ মিলিমিটার। কম বৃষ্টি নয়। ঢাকাসহ ছয় বিভাগের কোনো স্থানে এত বৃষ্টি হয়নি গতকাল। তারপরও সকাল আটটার দিকে আইকিউএয়ারের রাজধানী ঢাকার গড় বায়ুমান ছিল ১৪৭। এ মান অনেকটা খারাপ।
একটি অঞ্চলের বায়ুদূষণ কত, তাৎক্ষণিকভাবে তা জানায় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। তাদেরই হিসাব ছিল এটি। বৈশ্বিকভাবে এ পর্যবেক্ষণ বেশ গ্রহণযোগ্য। আইকিউএয়ার মোট ছয়টি মানদণ্ডে বাতাসের মান নির্ধারণ করে। এর মধ্যে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) যদি শূন্য থেকে ৫০ থাকে, তবে তা ভালো; ৫১ থেকে ১০০ হলে মোটামুটি, ১০১ থেকে ১৫০ সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুব অস্বাস্থ্যকর আর ৩০১ থেকে ওপরে একেবারে দুর্যোগপূর্ণ। আজ সকালে তাই সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ঢাকার বায়ু ছিল অস্বাস্থ্যকর।
এ গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েন বয়স্ক ব্যক্তি, অন্তঃসত্ত্বা, শিশু বা অসুস্থ কোনো ব্যক্তি। তবে সার্বিকভাবে বাতাসের মান এমন থাকলেও নগরীর কোনো কোনো স্থানে বায়ুর মান ছিল অস্বাস্থ্যকর। যাহোক, আকাশে ঘন মেঘ দেখে বৃষ্টির আশা করা হয়েছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ছিল তেমনই। আর তাতে আশা করা স্বাভাবিক ছিল, এ বৃষ্টিতে দূষণ কমবে। সকাল পৌনে নয়টার দিকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও হলো। আবহাওয়া অফিসের হিসাব বলছে, তিন ঘণ্টায় রাজধানীতে ৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল ইসলামের কথায়, এ সময়ে এ বৃষ্টি আসলে অনেক।
ঢাকার বায়ুদূষণ কমানোর অব্যর্থ দাওয়াই হলো বৃষ্টি। আসলে সরকারের নানা কথাবার্তা, নানা প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ হয়েছে ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে। তাই বৃষ্টিই ভরসা। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির পর দূষণ কমল কই? আইকিউএয়ারের তালিকায় চোখ গেলে ভুল দেখছি কি না, মনে করে ‘রিফ্রেশ’ দিলাম। না, একই অবস্থা। বেলা সোয়া ১২টার দিকে এই প্রতিবেদন লেখার সময় ঢাকার বায়ুর মান বেড়ে হয়েছে ১৬২। সকাল আটটার দিকে বিশ্বের ১২৭টি নগরীর মধ্যে ঢাকা ছিল ১১তম। আর এখন দেখছি তৃতীয়। ঢাকার অবস্থানের এই ‘উন্নতি’ (আসলে ভীষণ অবনতি) কেন এই বৃষ্টির মধ্যেও?
প্রশ্নটা করেছিলাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হকের কাছে। কিন্তু তারও প্রশ্ন, ‘বৃষ্টিতে তো দূষণ কমে যাওয়ার কথা। তারপরও এমন কেন হলো?’
শুধু আজ কিন্তু না, টানা বৃষ্টির পর গত এক সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ঢাকার বায়ুমান খারাপ ছিল। শুধু আইকিউএয়ারের নয়, খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যেই তার প্রমাণ মিলছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ ৭ অক্টোবরের (গত মঙ্গলবার) তথ্য দেওয়া আছে। দেখা গেছে, ওই দিন রাজধানীতে বায়ুর মান ছিল ১৩১, অর্থাৎ এ মান সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। আর ওই দিন সবচেয়ে দূষণ ছিল রংপুরে, ৬১২। আর যশোর ও রাজধানীর কাছের টঙ্গীর বায়ুর মান ছিল যথাক্রমে ১৫৯ ও ১৫২।
পরিবেশবিদ ও গবেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ঢাকার বাতাসে হয়তো নতুন কোনো দূষক যুক্ত হয়েছে। নয়তো এখন সক্রিয় দূষকের মধ্যে কোনোটির পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। কারণ, বৃষ্টি হওয়ার পরও এত দূষণ অস্বাভাবিক।
বিশেষজ্ঞদের এমন ধারণার কথা পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জিয়াউল হককে জানালে তাঁর উত্তর আসে, ‘এমন কোনো দূষকের সন্ধান তো আমরা পাইনি। দেখা দরকার; কিন্তু একটা উপাদানের কথা বলতে পারি, সেটি হলো উপমহাদেশীয় আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। এর পরিমাণ হয়তো বেড়ে গেছে।’
নিজের ঘরের পরিবেশ খারাপ রেখে প্রতিবেশীকে দোষ দিয়ে লাভ কী। এখন আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহকে দোষী করা হয়। এই উৎসের ভূমিকা অবশ্যই আছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বায়ুদূষণে। কিন্তু লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ির একটিকেও নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু এই বায়ুপ্রবাহকে দায়ী করাটা একেবারে হাস্যকর।ক্যাপস চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার
ঢাকার বায়ুদূষণের প্রসঙ্গ এলে সরকারের, বিশেষ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘কেষ্টা বেটা’ হলো আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে দূষণে বড় ভূমিকা রাখে, এমন কথা সবাই মানেন; কিন্তু এর পরিমাণ আসলে কত, এর উত্তর আসলে কেউ দিতে পারে না। এই বায়ুপ্রবাহ এবং বাংলাদেশের দূষণে এর ভূমিকা নিয়ে এর আগে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল। আর পরিবেশ অধিদপ্তর এ নিয়ে বলতেও ভালোবাসে। কিন্তু এর পরিমাণ যেমন জানা নেই, দূষণের অন্য উৎসগুলো বন্ধের তৎপরতাও সেই অর্থে নেই।
ঢাকার বায়ুদূষণের উৎসগুলোর মধ্যে আছে ইটভাটা, কলকারখানার ধোঁয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি। এসব উৎস নিয়ন্ত্রণ করতে কতটুকু কাজ করা হয়েছে বা হচ্ছে সেই প্রশ্ন আসছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলছিলেন, ‘নিজের ঘরের পরিবেশ খারাপ রেখে প্রতিবেশীকে দোষ দিয়ে লাভ কী। এখন আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহকে দোষী করা হয়। এই উৎসের ভূমিকা অবশ্যই আছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বায়ুদূষণে। কিন্তু লাখ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ির একটিকেও নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু এই বায়ুপ্রবাহকে দায়ী করাটা একেবারে হাস্যকর।’
আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দূষিত নগর ছিল ঢাকা। বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা। সেই উপাদান ধরেই এই বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। সেখানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৫ গুণ বেশি।
ঢাকার বা দেশের অন্যত্র বায়ুদূষণ কম থাকে মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। সবচেয়ে কম দূষণ থাকে জুলাই মাসে। এসব মাসে দূষণ কম থাকার একমাত্র কারণ বৃষ্টি। জুলাই দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টির মাস। এ মাসে বৃষ্টি হয় ৫২৩ মিলিমিটার। এর পরই আছে জুন মাস, ৪৫৯ মিলিমিটার। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে গড় বৃষ্টি যথাক্রমে ৪২০ ও ৩১৮ মিলিমিটার। মে মাসে বৃষ্টি ২৬৬ মিলিমিটার আর অক্টোবরে ১৮০ মিলিমিটার। তাই অক্টোবর ‘দূষণ শুরুর মাস’ হলেও এ মাসে বৃষ্টি বেশি হলে দূষণ সাধারণত কম থাকে।
এর আগে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছিল, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণসহ চার ধরনের পরিবেশদূষণে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। এ ছাড়া দূষণের কারণে ওই বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ‘দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস (সিইএ)’ নামের প্রতিবেদনটি গত বছরের (২০২৪) মার্চ মাসে প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক।
বাংলাদেশে গড়পড়তা দূষণের পরিমাণ (পিএম ২.৫ ধরে) মোটামুটি ৭৫ মাইক্রোগ্রাম। তবে জুন মাসে তা থাকে ৩৬, জুলাইয়ের ৩১, আগস্টে ৩৮, সেপ্টেম্বরে ৩৮ এবং অক্টোবরে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। গড় ৯ বছরের প্রবণতা তুলে ধরে ক্যাপসের গবেষণায় এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মজুমদার বলছিলেন, ‘চলতি বছরের বৃষ্টির মাসগুলোতেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দূষণ থেকেছে। এবার অক্টোবরের শুরু থেকে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা একটা ভয়ানক দূষণ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। হয়তো আমাদের দূষণহীন মাসগুলোও আগামী দিনগুলোতে বেশি দূষিত হয়ে উঠতে পারে। এভাবে বায়ুদূষণে আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে আছি।’