যে জীবন ফড়িংয়ের

আদমপুর বিটে একটি স্ত্রী নদীরত্ন
ছবি: লেখক

বিরল ও বিপন্ন এক পাখির খোঁজে বন বিভাগের বিশেষ অনুমতি নিয়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরে এসেছি। প্রায় দুই কিলোমিটার বন ও উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে ছবির মতো সুন্দর এক ছড়ায় এসে পৌঁছালাম। ছড়ায় নামার সময় পিছলে প্রায় পানিতে পড়তে বসেছিলাম।

ছড়ার কাকচক্ষু জলে গায়ে লেগে থাকা কাদা ধুয়ে নিলাম। বসলাম পানিতে হেলে পড়া একটি গাছের গুঁড়ির ওপর। খানিক অপেক্ষার পর পাখিটি এল। কোনো শব্দ না করে চুপচাপ ওর ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষ করে ছড়ায় পায়চারি করতে লাগলাম।

পায়চারি করতে করতে সামান্য এগিয়ে গেছি, দেখি ঠিক সামনে এক জোড়া বর্ণিল পতঙ্গ উড়ছে। প্রথমে তেমন গুরুত্ব দিইনি। পরে ওদের ওড়াউড়ির ধরন দেখে সন্দেহ হওয়ায় ভালোভাবে খেয়াল করলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একটি পতঙ্গ আরেকটিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ওদের ওড়াউড়িটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল বলে নষ্ট না করে দ্রুত বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম। এরপর ছবি পর্যালোচনা করতে গিয়েই ওদের চিনতে পারলাম। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরেও এই আদমপুরেই প্রথম ওদের ছবি তুলেছিলাম। তখন স্ত্রী-পুরুষ দুটোই পেয়েছিলাম। এবার অবশ্য স্ত্রীটিকে দেখলাম না।

পতঙ্গগুলো আমাদের অতি পরিচিত ফড়িং। তবে দেখা ফড়িং থেকে ওরা ভিন্ন। ওরা সরুদেহী ফড়িং বা ড্যামজেলফ্লাই। ফড়িং অতি প্রাচীন পতঙ্গ। পৃথিবীতে এসেছে ৩০ হাজার বছরের আগে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ হাজার ৩৮০টি প্রজাতি নিয়ে বৈচিত্র্যময় ফড়িং বর্গ অডোন্যাটা গঠিত। ফড়িং দুই ধরনের—ড্রাগনফ্লাই বা সুঠামদেহী ফড়িং আর ড্যামজেলফ্লাই বা সরুদেহী ফড়িং।

ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ১৫০ প্রজাতির ফড়িং রয়েছে। ড্রাগনফ্লাই আকারে বড় আর শক্তপোক্ত। এরা অ্যানিসপ্টেরা উপবর্গের সদস্য। আর ড্যামজেলফ্লাই ছোট ও সরু দেহের অধিকারী। এরা জাইগোপ্টেরা উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত। বেশির ভাগ ড্যামজেলফ্লাই বিশ্রামের সময় ডানা ভাঁজ করে রাখে, কিন্তু ড্রাগনফ্লাই বিশ্রামের সময় ডানা প্রসারিত করে রাখে।

তবে ফড়িং বলতে সাধারণভাবে ড্রাগনফ্লাই আর ড্যামজেলফ্লাই—দুটোকেই বোঝায়। ড্রাগনফ্লাই চটপটে ও দ্রুত ওড়ে। ড্যামজেলফ্লাই ওড়ে দুর্বলভাবে। প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক—দুই পর্যায়ের ফড়িংই শিকারি। অন্যান্য কীটপতঙ্গ খায়। কিছু প্রজাতির শৈশবকাল পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কগুলো মাত্র কয়েক দিন থেকে ১০ সপ্তাহ বাঁচে। ফড়িংকে জলজ পরিবেশের সুস্থতার প্রতীক বলে গণ্য করা হয়। ওদের শৈশবকাল পুকুর, হ্রদ, নদীসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ আবাসস্থলে কাটে। জলাভূমি সংকুচিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ওরা হুমকির মুখে পড়ছে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুরে ছড়ার ওপর উড়ন্ত দুটি পুরুষ নদীরত্ন ফড়িং

আদমপুরে সেদিন দেখা ফড়িংটি দুর্লভ ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন। ইংরেজি নাম রিভার হেলিওডর, ইন্ডিয়ান ইয়েলো-লাইন্ড জেম বা গোল্ডেন জেম। এ দেশের ফড়িংগুলোর বাংলা নাম পাওয়া যায় না। তাই ইংরেজি নামের অনুকরণে আমি ওর নাম দিয়েছি নদীরত্ন। ক্লোরোসাইফিডি গোত্রের সরুদেহী ফড়িংটির বৈজ্ঞানিক নাম Libellago lineata। ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলের পাহাড়ি জলধারার পাশে বাস করে। বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

নদীরত্ন অতি সুন্দর ফড়িং। উদর বা পেট ২৯ থেকে ৩২ মিলিমিটার, পেছনের ডানা ৩৭ থেকে ৪১ মিলিমিটার। পুরুষের বুক-পেটে কালো ও হলুদ দাগছোপ থাকে। বয়সের সঙ্গে কালচে ভাব বাড়ে। পা কালো। তাতে সাদা দাগ রয়েছে। গাঢ় হলুদ পক্ষমূলসহ পুরুষের ডানা হলদে। পেছনের ডানার ডগায় তিনকোনা কালচে ছোপ এবং সামনের ডানায় ডগার প্রান্তে কালো দাগ থাকে। আবার স্ত্রী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের বুক-পেট কালো এবং জলপাই-সবুজ দাগছোপযুক্ত।

স্ত্রী কিছুটা মোটাসোটা। পা কালো। পক্ষমূলে হলদে আভাসহ স্ত্রীর ডানা প্রায় বর্ণহীন। উভয় ডানার ডগার প্রান্তে হালকা হলদে দাগ। অন্যান্য ড্যামজেলফ্লাইয়ের মতো ওদের পুঞ্জাক্ষি দুটো পরস্পর থেকে আলাদা ও কিছুটা দূরে অবস্থিত। পুরুষের পুঞ্জাক্ষি বাদামি-কালো; স্ত্রীরটির ওপরটা বাদামি-কালো ও নিচটা সাদাটে। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষ মুখমণ্ডল চকচকে কালো। লেজও কালো।

দিবাচর পতঙ্গগুলো পানিতে অবস্থিত ঘাস, পাথর বা গাছের গুঁড়িতে বসে থাকে। দিনের পর দিন একই জায়গায় দেখা যায়। সারা বছরই ওড়াউড়ি করে। পুরুষগুলো নিজের এলাকায় অন্য পুরুষকে প্রবেশ করতে দেয় না, তাড়িয়ে নিয়ে যায়। পাহাড়ি জলধারা ও নদীতে প্রজনন করে। স্ত্রী আংশিকভাবে নিমজ্জিত, ক্ষয়প্রাপ্ত গাছের ওপর ডিম পাড়ে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ