গভীর জলের তিমি

বাইড্রেস তিমি, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড থেকে তোলা
ছবি: আবদুল্লাহ আবু দায়ান

মে মাসের ২২ তারিখ, হঠাৎ করেই কুয়াকাটা সৈকতে হইচই পড়ে গেল। বিরল জাতের এক ডলফিন দেখা গেছে। কেউবা আবার বলছে হাঙর। বেশ কটি খবরের কাগজে ছাপাও হলো এ খবর। উদ্ধারকারী দলের সদস্য আরিফ কুয়াকাটা থেকে পুরো ঘটনা আমাকে জানালেন। ছবি দেখে এই প্রাণীকে ডলফিন বা হাঙর মনে হলো না কোনোভাবেই।

অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য সেখানে বসবাসরত ওয়ার্ল্ডফিশের সহকর্মী সাগরিকা স্মৃতিকে ফোন দিলাম। পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনে মনে হলো এটি একটি তিমি। তারপর কথা হলো ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের গবেষক মোগলিজ এলিজাবেথ রুবাইয়াতের সঙ্গে। তাঁরা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিত প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করলেন। এটি একটি গভীর জলের তিমি। নাম ডোয়ার্ফ স্পার্ম হোয়েল। বাংলাদেশের জন্য নতুন প্রজাতির তিমি। জীবিত অবস্থায় এটিই এ প্রজাতির তিমির প্রথম দেখতে পাওয়ার তথ্য। সৈকতে তিমিটির আচরণ দেখে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। গভীর সাগর থেকে সৈকতের দিকে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল তিমিটি। স্থানীয় লোকজন বারবার চেষ্টা করেও তাকে আর সাগরে ফিরিয়ে দিতে পারেননি। সেদিনই তিমিটি মারা যায়।

ডোয়ার্ফ স্পার্ম তিমিটির পেটে বাচ্চা ছিল। এ জাতের তিমি মাত্র একটি বাচ্চা প্রসব করলেও এর পেটে দুটি বাচ্চা ছিল। এ ধরনের ঘটনা একেবারেই বিরল। তিমিটি কুয়াকাটা সৈকতে কী কারণে চলে আসার চেষ্টা করেছিল, তার প্রকৃত তথ্য আমাদের হাতে নেই। তার মৃত্যুর কারণ বলাও বেশ কঠিন। তবে গবেষকেরা বলছেন, ভুলক্রমে তিমিরা অনেক সময় প্লাস্টিক দ্রব্যাদি খেয়ে ফেলে, যা তাদের পরিপাকতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করে। এরপর তারা আর খাবার গ্রহণ করতে পারে না। অনাহারে মৃত্যু হয়। খুব সম্ভবত এ তিমির ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।

করোনার পুরো সময়কালে আমাদের সৈকতে তিমি মারা যাওয়ার ঘটনা আরও ঘটেছে। গত বছরের ৯ ও ১০ এপ্রিল দুটি মৃত তিমি কক্সবাজার সৈকতে ভেসে এসেছিল। তিমি দুটি ছিল প্রাপ্তবয়স্ক বাইড্রেস তিমির জাত। তার আগের বছরও প্রায় একই সময় একই জাতের একটি বাচ্চা তিমি ভেসে এসেছিল। প্রায় প্রতিবছরই আমরা তিমি মরার খবর পাই। তবে কী কারণে এসব তিমি মারা পড়ছে, তার উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য নেই। গবেষকসহ অনেকেরই ধারণা, মাছ ধরার বড় ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে এদের মৃত্যু হতে পারে। তবে দুটি তিমি একই সময় এভাবে ধাক্কা খেয়ে মারা যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। তিমি খুবই বুদ্ধিমান জলজ স্তন্যপায়ী। এ জাতের প্রাণী ইকোলোকেশনের মাধ্যমে পানিতে যেকোনো বস্তুর অবস্থা বুঝতে পারে।

তিমি নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা নেই। তবে ২০০৪ থেকে ২০১২ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে এক গবেষণায় দেখা যায়, এখানে প্রায় ১৫টি বাইড্রেস তিমি আছে। এ সময়ের মধ্যে সোয়াচে প্রায় ১৪৮ বার তিমি দেখা গেছে। বাংলাদেশের সীমানায় সোয়াচ ৯০০ মিটার বেশি গভীর। সরকার এখানকার প্রায় ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে মাত্র ২৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৯০ ভাগ তিমি বিচরণ করে।

ডোয়ার্ফ স্পার্ম তিমি। নতুন জাতের এ তিমির দেখা মেলে গত ২২ মে, কুয়াকাটায়

বাংলাদেশের সীমানায় তিন জাতের তিমি আছে বলে এখন পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়। তবে বাইড্রেস তিমিই আমাদের গভীর জলের সীমানায় সহজেই দেখা যায়। অন্য দুটি প্রজাতির মধ্যে ডোয়ার্ফ স্পার্ম তিমি, যেটি এ বছরই প্রথম দেখা গেল। অন্য আরেকটি প্রজাতির নাম মিনকি তিমি। একবারই দেখার তথ্য আছে সোয়াচে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। কাজেই বাইড্রেস তিমি ছাড়া অন্য দুটি প্রজাতি এ দেশে নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে ২০১৫ সালে আইইউসিএন যে লাল তালিকা তৈরি করে, সেখানে বাইড্রেস তিমিকে তথ্যের অভাব বা ডেটা ডেফিশিয়েন্সি হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এ জাতের তিমি সংকটাপন্ন নয়। বাইড্রেস তিমি লম্বায় ৪০ থেকে ৫৫ ফুট পর্যন্ত হয়। এরা সাধারণত ৫০ ফুট পানির নিচে থাকে। তবে ৫ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে এগুলোকে পানির ওপর ডাইভ দিতে দেখা যায়। সাঁতার কাটে ঘণ্টায় প্রায় চার মাইল বেগে। প্রতিদিন গড়ে এদের ৬০০ কেজি খাবারের প্রয়োজন পড়ে। এ জাতের তিমি প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ৯ বছর বয়সে এরা প্রজননক্ষম হয়।

সোয়াচই আমাদের তিমির বেঁচে থাকার একমাত্র বিচরণক্ষেত্র। তিমির চলাচল এলাকায় সাগরদূষণ আর বড় জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। সোয়াচকে গবেষণার আওতায় এনে তিমি–সহায়ক পরিবেশ দিতে পারলেই গভীর জলের এই স্তন্যপায়ী প্রাণী টিকে থাকবে ভালোভাবে।