
প্রাণিচিকিৎসাবিজ্ঞানের এক সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। একসময় এখানে পড়াশোনা করেছি। শিক্ষকতাও করেছি। পুরোনো স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে উদ্ভিদ উদ্যানে ঢুকে পড়লাম। ফুলে ফুলে শোভিত উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে বহুপুষ্পিকাগাছের (ফায়ার ফ্লেম বুশ) কাছে চলে এলাম। পুরো গাছ আগুনে লাল ফুলে ছেয়ে আছে।
গাছজুড়ে যেন ছোট ছোট পাখি মধুপানের উৎসবে মেতে উঠেছে! ফুলে ফুলে রসপানে ব্যস্ত দেশের সুন্দরতম পাখি নীল টুনি, সিঁদুরে মৌটুসি ও মৌটুসিরা। একসঙ্গে একই গাছে তিন প্রজাতির দুই ডজন সুন্দর পাখি দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। আগুনে লাল ফুলে সিঙ্গাপুরের জাতীয় পাখি সিঁদুরে মৌটুসিগুলোকে নীল টুনির চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছিল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা এটি।
প্রজাপতি ছাড়া পৃথিবীতে কোনো উড়ন্ত সৌন্দর্য থাকলে, তা হলো পাখি। তবে পাখির রাজ্যে কোনটি সুন্দরতম, তা বলা কঠিন। কারণ, একেকটি একেক দিকে সুন্দর। এ দেশের কমবেশি ৭২২ প্রজাতির পাখির মেলায় সুন্দর পাখির সংখ্যাও অনেক। তবে অনেকের মতে মধুচুষকি (নেকটারিনিইডি) পরিবারের পাখিরাই সুন্দরতম, বিশেষত মৌটুসিরা (সানবার্ড)। কারণ, ওদের সৌন্দর্য সবখানেই ছড়িয়ে আছে—কি গায়ের রঙে, ওড়ার ঢঙে, গান গাওয়ায় বা বাসা তৈরিতে। আবার মৌটুসিদের মধ্যে নীল টুনিই সুন্দরতম হিসেবে গণ্য।
মধুপানের জন্য মৌটুসিদের রয়েছে লম্বা ও নিচের দিকে বাঁকানো ঠোঁট। আর পালকের বাহারি রং, যা শুধু পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাহারি পালকগুলোর ওপর সূর্যের আলো পড়লে চকচক করে ওঠে, তখন সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে যায়! তারা পুরো বিশ্ব, অর্থাৎ আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বের ১৪৬ প্রজাতির মৌটুসির মধ্যে এ দেশে রয়েছে ৯টি, যার ৫টি আবাসিক ও ৪টি পরিযায়ী। তাদের মধ্যে ৬টির দেখা পেয়েছি। অন্য ৩টি অতি বিরল, সম্প্রতি কেউ দেখেছে বলে শুনিনি। এখানে ৬ প্রজাতির মৌটুসির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।
১. নীল টুনি (পারপল সানবার্ড): দুর্গা টুনি বা বেগুন টুনি নামেও পরিচিত। পাখিটির প্রথম ছবি তুলি ২০০৮ সালে। এ দেশের সুন্দরতম ও বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটি আমার বাসার কাঁঠালগাছে বেশ কয়েকবার বাসা করেছিল। মানুষের কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করে। শহর-বন্দর-গ্রাম-বন-জঙ্গল—সবখানেই দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, চীন প্রভৃতি দেশে বিস্তৃত। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার, যার মধ্যে ঠোঁটটিই ৪ সেন্টিমিটার।
২. সিঁদুরে মৌটুসি (ক্রিমসন সানবার্ড): দুর্লভ পাখিটিকে প্রথম দেখি রংপুরে, ২০১০ সালে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় একসঙ্গে দেখেছি ময়মনসিংহে। দেশের প্রায় সব বনাঞ্চল, বাগান এলাকায় দেখা যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত। লম্বায় পুরুষ ও স্ত্রী যথাক্রমে ১৫ ও ১০ সেন্টিমিটার।
৩. সবুজাভ মৌটুসি (রুবি-চিকড সানবার্ড): সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটি পুরো দেশের বন ও আশপাশে থাকে। এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত। অন্যান্য মৌটুসির তুলনায় ঠোঁট ছোট। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১১ সেন্টিমিটার।
৪. মৌটুসি (পারপল-রাম্পড সানবার্ড): নীল টুনির মতো তারাও দেশের বাগান ও গাছপালাসমৃদ্ধ এলাকার বাসিন্দা। বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটিকে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটারের কম।
৫. বেগুনি-গলা মৌটুসি (পারপল থ্রটেট/ ভ্যান হেসেল্টস সানবার্ড): সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটির অন্য নাম বেগুনি বুক মৌটুসি। দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের পাখিটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত। লম্বায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার।
৬. সিঁদুরে হলুদ মৌটুসি (মিসেস গোল্ডস সানবার্ড): অতি সুন্দর বিরল পরিযায়ী পাখিটি এ দেশে অনিয়মিত। হিমালয়ের আশপাশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শীতে কখনো এ দেশে আসে। লম্বায় পুরুষ ১৪ থেকে ১৫ ও স্ত্রী ১০ সেন্টিমিটার। ওজন ৬ দশমিক ১ থেকে ৮ দশমিক শূন্য গ্রাম।
প্রায় সব প্রজাতির মৌটুসিই হামিংবার্ডের মতো হোভারিং করে, অর্থাৎ শূন্যে স্থির থেকে ফুলের মধু পান করতে সক্ষম। মধুর অভাবে ছোট ছোট পোকামাকড় ও মাকড়সা খায়। চঞ্চল পাখিগুলো বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না। বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে আলোর ঝিলিকের মতো এ গাছ থেকে ও গাছে, এ ফুল থেকে ও ফুলে উড়ে বেড়ায়।
প্রজাতিভেদে মার্চ থেকে আগস্টে প্রজনন করে। কোনো কোনো প্রজাতি, যেমন নীল টুনি, মৌটুসির দুই থেকে তিনবার প্রজননকাল। গাছের পাতায় মাকড়সার জাল ও শেওলা দিয়ে ছোট্ট ঝুলন্ত বাসা বানায়। প্রজাতিভেদে দুই থেকে তিনটি সাদাটে ডিম পাড়ে, যাতে হালকা লালচে-বাদামি ছোপ ছোপ দাগ থাকে। ডিম ফোটে ১৪ থেকে ১৫ দিনে। আয়ুষ্কাল ৩ থেকে ৮ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান: পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ