বাড়িটিতে বেশির ভাগই বকের বাস। কিছু শালিক, বুলবুলিকে গাছের ডালে ডালে অবিরাম কিচিরমিচির করতে দেখা গেল।

সন্ধ্যা হলে গোটা বাড়িই যেন পাখিদের দখলে চলে যায়। বাঁশঝাড়, সুপারিগাছ, আমগাছ—সব গাছই তখন পাখিদের দখলে। গাছের চূড়ায়, ডালে ক্লান্ত ডানা গুটিয়ে বসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে, সবুজ গাছপালার ভেতর ফুটে আছে থোকায় থোকায় সাদা ফুল। পাখিদের কলকাকলিতে সকাল-সন্ধ্যা মুখর থাকে বাড়িটি। বাড়ির লোকজনও পাখিদের এই আনাগোনা আর সরব উপস্থিতি মেনে নিয়েছেন।
তবে পাখির মায়ায় তাঁদের ছাড়তে হয়েছে বাড়ির সুপারি, আম, জামসহ সব ধরনের গাছের ফল ও পুকুরের মাছ খাওয়ার আশা। পাখির বিষ্ঠার কারণে গাছে ফল, পুকুরে মাছ হয় না। এ নিয়ে কিছুটা খেদ থাকলেও ক্ষোভ নেই তাঁদের। পাখিরা এখন বাড়ির অন্য সব প্রাণবৈচিত্র্যের অংশ হয়ে গেছে। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের শ্যামেরকোনা গ্রামের সুন্দর আলীর বাড়িটি বছরজুড়েই এখন পাখিদের ঘরবসতি।
‘একসঙ্গে থাকতে থাকতে পাখির বিটের (বিষ্ঠা) গন্ধ এখন তেমন টের পাই না। তবে সুপারিগাছে ফল আসে না। বাঁশ মরে যায়। আমগাছেও কম ফল আসে। যা আসে, বিটের কারণে তা–ও খাওয়া যায় না। পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারি না। মাছ খাইতে পারি না। সব আমরা মেনেই নিয়েছি। পাখি তো, কিছু করার নাই। তারার (পাখির) ইচ্ছায় আসে। তারার ইচ্ছায় যায়।’ফাহিমা আক্তার, বাড়ির তত্ত্বাবধানকারী
গত শুক্রবার বিকেলে মৌলভীবাজার-কমলগঞ্জ সড়কের শ্যামেরকোনা বাজার থেকে রাস্তার পূর্ব দিকে ইটবিছানো পথ ধরে খানিক এগোলেই বাড়িটির দেখা পাওয়া যায়। গাছগাছালিতে ঘেরা বড় বাড়ি। অনেক ধরনের গাছ বাড়িটিকে আগলে রেখেছে। বাড়ির সামনের দিকে গ্রামীণ রাস্তা।
অন্য তিন দিকেই খোলা মাঠ। বাড়ির ভেতরে দুই দিকে দুটি পাকা দালান। বাঁশবনে, আমগাছে কিছু বাসায় বসে আছে বক। অল্প কিছু পাখি বিচ্ছিন্নভাবে এখানে-ওখানে বসেছে। কিছু শালিক, বুলবুলি গাছের ডালে ডালে অবিরাম কিচিরমিচির করে চলেছে। সুপারিগাছে ঝুলে আছে বাবুই পাখির বাসা। একসময় তালগাছে এমন করে বাবুই পাখির বাসা দেখা যেত। তালগাছ কমে গেছে।
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হয়তো সুপারিগাছে আশ্রয় নিয়েছে বাবুই পাখিরা। বিকেলের আলো কিছুটা ম্লান হতেই বাড়ির চেহারাও বদলে যেতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা বক উড়ে আসতে লাগল। বাড়ির ওপর দুই ডানা সোজা ও কাত করে চক্কর দিয়ে গাছে গাছে নামতে থাকে তারা। মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির সবুজ গাছপালা সাদা হয়ে যায়। পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে গোটা বাড়ি। কোথাও অন্য রকম, ভীতিকর কিছুর সাড়া পেলে একসঙ্গে আবার সবাই উড়াল দেয়।
আবার চুপচাপ এসে ডালে বসে। বাড়িজুড়ে পাখির ওড়াউড়ি, ছটফটানি। তবে এ অবস্থা বেশিক্ষণ থাকে না। সন্ধ্যা যতই ঘন হয়ে আসে, অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে, পাখিরাও স্তব্ধ হয়ে যায়। একসময় বাড়িজুড়ে নেমে আসে নীরবতা।
শ্যামেরকোনা বাজারের ব্যবসায়ী সজল দেবনাথ বলেন, ‘অনেক বছর ধরে ওই বাড়িতে পাখি দেখে আসছি। গ্রামের আর কোনো বাড়িতে পাখি নেই। হাজারের ওপর পাখি বাড়িটিতে আশ্রয় নেয়। বিকেলে পাখিরা এলে অনেক সুন্দর লাগে।’
বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাড়িটি তৈরি হয়েছে ১৯৮৯ সালে। তবে পাখির আনাগোনা শুরু হয়েছে ১৫-১৬ বছর ধরে। শুরুতে ছোট পাখিরাই বেশি ছিল। শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, বুলবুলি ইত্যাদি। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সন্ধ্যা হলে মাতিয়ে রাখত বাড়ি। তাদের সঙ্গে একসময় ভেড়ে খয়েরি ও সাদা রঙের বক।
তবে বকেরা সারা বছর থাকত না। বর্ষার শুরুতে আসত, দু-তিন মাস থেকেই চলে যেত। সংখ্যায়ও তেমন বেশি ছিল না। সাত-আট বছর ধরে প্রায় নিয়মিতই পাখির বাড়ি হয়ে গেছে এটি। প্রায় সারা বছরই কিছু বক বাড়িটিতে থাকে। বৈশাখে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বাড়ির বাঁশঝাড়, আমগাছসহ বিভিন্ন গাছে নতুন নতুন বাসা বানাতে থাকে। বাসায় ডিম পাড়ে।
বাচ্চা ফোটে। সকাল হলেই গাছপালা খালি করে পাখিরা উড়ে যায়। দিনের বেলা বোঝার উপায় নেই, বাড়িটি রীতিমতো পাখির অভয়ারণ্য। তবে প্রজননের সময় বাসাগুলোতে সারা দিনই দু-একটা পাখি বসে থাকে। শীত শুরুর আগপর্যন্ত এভাবেই বাড়িটি পাখির কলরবে মুখর থাকে।
শুধু বকই নয়, সঙ্গে কিছু বালিহাঁসেরও দেখা মেলে বকের ঝাঁকে। তবে কিছু সমস্যা তো থাকেই। কিছু লোক মাঝেমধ্যে বাড়ির বাইরে থেকে পাখি শিকারের চেষ্টা করেন। বাড়ির লোকজন বাধা দেন। এতে আর কেউ শিকারের সাহস করেন না অবশ্য।
বাড়ির তত্ত্বাবধানকারী ফাহিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসঙ্গে থাকতে থাকতে পাখির বিটের (বিষ্ঠা) গন্ধ এখন তেমন টের পাই না। তবে সুপারিগাছে ফল আসে না। বাঁশ মরে যায়।
আমগাছেও কম ফল আসে। যা আসে, বিটের কারণে তা–ও খাওয়া যায় না। পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারি না। মাছ খাইতে পারি না। সব আমরা মেনেই নিয়েছি। পাখি তো, কিছু করার নাই। তারার (পাখির) ইচ্ছায় আসে। তারার ইচ্ছায় যায়।’