হলুদ শাপলা প্রথম দেখি বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ফুলটি বিভিন্ন উদ্যান ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে দেখা যায়। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যান ও জামালপুরের কাপাসহাটিয়া গ্রামের মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর প্রাঙ্গণে হলুদ শাপলা দেখা যায়। এই ফুল আমাদের দেশের জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় না। এ কারণে ফুলটি নিয়ে আগ্রহেরও কমতি নেই।
আমাদের জলাশয়গুলোতে বিচিত্র ধরনের শাপলাসহ অনেক জলজ ফুল ফোটে। তবে জলাশয়গুলো অপরিকল্পিতভাবে ভরাট হওয়ায় এবং দূষণের কারণে এসব ফুলের সংখ্যা কমছে। শাপলার যে প্রজাতিটি আমাদের জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃত, সে ফুলের প্রাকৃতিক আবাসও প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। বিল-ঝিলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সাদা পদ্ম এখন বিরল হয়ে উঠেছে। অনেকেই শখ করে এই পদ্ম চাষ করেন। হলুদ শাপলা বা সোনালি শাপলাও একইভাবে সীমিত পরিসরে চাষ করা হয়। সাধারণত শখ করে রোপণ করা হয় এই ফুল। আমাদের জলাশয়ে বিচিত্র শাপলার সঙ্গে অন্যতম সংযোজন হলুদ শাপলা। এরা পানির ৫ মিটার গভীর পর্যন্ত স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে পারে। বদ্ধ জলাশয়ে জন্মে বেশি। কালচে সবুজ পাতাগুলো সাধারণত পানিতে ভাসে, দৈবাৎ পদ্মপাতার মতো কিছুটা ওপরও থাকতে পারে।
হলুদ শাপলা (Nymphaea amazonum) বহুবর্ষজীবী জলজ বীরুৎ। পাতা বর্তুলাকার, পাদদেশ হৃৎপিণ্ডাকার এবং গোলাকার খণ্ডকবিশিষ্ট, অখণ্ড, নিচের পিঠ সচরাচর লালচে বাদামি। বৃত্যংশ শৈলশিরাময় নয়, বাইরের পীঠ হলুদাভ সবুজ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোলাপি বিন্দুবিশিষ্ট, অখণ্ড এবং আগা তীক্ষ্ণ। পাপড়ি হলুদাভ সাদা, ৪ থেকে ৫টি সারিতে সজ্জিত। পুংকেশর অসংখ্য, ৫ বা ততধিক শ্রেণিতে বিন্যস্ত, বাইরের পুংকেশরগুলো হলুদাভ সাদা, ভেতরেরগুলো হলুদ। গর্ভপত্র প্রায় ১ সেন্টিমিটার লম্বা, গর্ভমুণ্ডের রশ্মি ১০ থেকে ১৫টি। ফুল ও ফলের মৌসুম এপ্রিল থেকে আগস্ট। আদি আবাস উষ্ণমণ্ডলীয় আমেরিকা।
আমাদের জলাশয়গুলোতে বিচিত্র ধরনের শাপলাসহ অনেক জলজ ফুল ফোটে। তবে জলাশয়গুলো অপরিকল্পিতভাবে ভরাট হওয়ায় এবং দূষণের কারণে এসব ফুলের সংখ্যা কমছে। শাপলার যে প্রজাতিটি আমাদের জাতীয় ফুল হিসেবে স্বীকৃত, সে ফুলের প্রাকৃতিক আবাসও প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে।
নিম্ফিয়া লোটাস
শাপলা ফুলের কোনো রকমফের যে পদ্ম নামে পরিচিত হতে পারে, তা জানা ছিল না। ফুলটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Nymphaea Lotus তো সে কথাই প্রমাণ করে। ফুলটি নিয়ে লিখতে বসে এসব তথ্য জানা হলো। আমাদের জলাশয়গুলোতে যেসব শাপলা দেখা যায়, তার চেয়ে এ ফুল আকারে বেশ বড়। দেখেছি ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। অন্যান্য শাপলা ফুল থেকে তুলনামূলক বড়, পাপড়ির সংখ্যাও বেশি। এ কারণে সহজেই নজর কাড়ে। হলুদ শাপলার মতো এটিও আমাদের দেশে আবাদিত। সাধারণত শোভাবর্ধক হিসেবে বিভিন্ন জলাশয়ে চাষ করা হয়। এই ফুল নিম্ফিয়া পদ্ম, সাদা মিসরীয় পদ্ম, বাঘ পদ্ম অথবা মিসরীয় জলজ লিলি নামেও পরিচিত। এটি মিসরের জাতীয় ফুল।
নিম্ফিয়া পদ্ম মোথাকন্দযুক্ত, বহুবর্ষজীবী, জলজ উদ্ভিদ। ভাসমান পাতাগুলো অসমান প্রান্তসহ ৫০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত। পাতার শিরা স্পষ্ট। সাদা বা ক্রিম রঙের ঈষৎ সুগন্ধি বৃন্তযুক্ত এই নিশিপুষ্প পানির সমান্তরাল থেকে প্রায় ২০ সেন্টিমিটার ওপরে বিস্তৃত। ধাবক শল্কযুক্ত। স্থূলকায়, ০.৬ থেকে ২.০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত বৃন্তটিতে ৬টি কেন্দ্রীয় এবং ১২টি গৌণ বায়ু নালি রয়েছে। ফুলটিতে ৪টি সবুজ, ডিম্বাকার এবং ২৩ সেন্টিমিটার প্রশস্ত বৃত্যংশ রয়েছে। ১৯ থেকে ২০টি ডিম্বাকার পাপড়ির সমন্বয়ে একটি গোলাকার শীর্ষ রয়েছে। তাতে হলুদ পুংকেশর লক্ষণীয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস ১৭৫৩ সালে প্রথম এই গাছের বৈজ্ঞানিক তথ্য লিপিবদ্ধ করেন।
এটি পূর্ব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মে। নিম্ফিয়া পদ্মের মোথাকন্দসহ শুষ্ক মৌসুমে টিকে থাকার ব্যতিক্রমী ক্ষমতা রয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশে খুব সহজেই বেঁচে থাকতে পারে। শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাষ করা হয়। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে এই ফুলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কন্দ এবং বীজ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক