হাওরজুড়ে অথই পানি। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছুটে চলেছে বাহারি নৌকা। হাওরপাড়ে মানুষের ভিড়। নৌকার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হুল্লোড় করছেন তাঁরা। ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ঘিরে শুক্রবার উৎসবের এই আমেজ তৈরি হয়েছিল মৌলভীবাজারের জুড়ীর নয়াগ্রাম ও খালের মুখে।
হাকালুকি দেশের বৃহত্তম হাওর। মৌলভীবাজার ও সিলেটে ২৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে এর বিস্তৃতি। হাওরের নয়াগ্রাম ও খালেরমুখ বাজারের বাসিন্দারা শুক্রবার সেখানে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। নৌকাবাইচ দেখতে ছুটে এসেছিলেন দূরদূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ।
দুপুরের পর থেকে ছোট-বড় নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করেন অনেকেই। বিকেল গড়াতেই ভিড় জমে যায়। আশপাশের রাস্তায় জড়ো হন বহু মানুষ। হাওরপারের নয়াগ্রামের রাস্তায় ঝালমুড়ি, বাদাম, আমড়া, আইসক্রিম ও ঠান্ডা পানীয়র অস্থায়ী দোকান নিয়ে বসেছিলেন স্থানীয় লোকজন।
বিকেল চারটার দিকে শুরু হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। লম্বা ও সরু নৌকায় একসঙ্গে বইঠা চালান অনেক মাঝি। সমস্বরে বইঠার ছন্দ আর তালের সঙ্গে ঢাক-ঢোলের আওয়াজ ও গানে গানে বাইচ চলতে থাকে। হাওরের দুই পাড়ে উপচে পড়া মানুষের উল্লাসে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।
নৌকাবাইচ দেখতে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা ভাড়া করে এসেছেন বাবুল আহমদ। জুড়ীর জাঙ্গিরাই এলাকার এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘শুক্রবার দোকান বন্ধ থাকে। তাই এলাকার কয়েকজন মিলে চলে এলাম। নৌকাবাইচ দেখা হলো, হাওরও ঘুরে ঘুরে দেখলাম।’
গ্রামীণ জনজীবনে নৌকাবাইচ একটি প্রাণের উৎসব। বর্ষার পর নদী যখন পানিতে টইটম্বুর, তখনই নদীপারের গ্রামগুলো রঙিন হয়ে ওঠে নৌকাবাইচ ঘিরে।
কর্মসূত্রে কাতারে থাকেন বড়লেখার সুজানগর এলাকার নজমুল ইসলাম। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে আসা এই প্রবাসী বলেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবে নৌকাবাইচ দেখি। বিদেশে থাকায় অনেক দিন সরাসরি দেখা হয়নি। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এলাম।’
আশপাশের এলাকা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে গাড়িতে বা নৌকায় করে বাইচ দেখতে এসেছিলেন হাজারো মানুষ। কেউ কেউ নিজেদের মুঠোফোনে সেই দৃশ্য ধারণ করছিলেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশপাশে ঘুরেও দেখছিলেন কেউ কেউ।
নৌকাবাইচ দেখতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছিলেন বলে দাবি করলেন আয়োজকদের একজন নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মূলত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখা ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আমরা নৌকাবাইচের আয়োজন করেছি।’
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল তিনটি দল। একটি কুলাউড়া উপজেলার সাদিপুরের, একটি বড়লেখার ভোলারকান্দির আর একটি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার নূরজাহানপুরের। নৌকাবাইচে সাদিপুর প্রথম, নূরজাহানপুর দ্বিতীয় ও ভোলারকান্দি দল তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
নৌকাবাইচ শেষে সন্ধ্যার পর পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কুলাউড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজমল হোসেন, জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুরশেদুল আলম ও জুড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জায়ফরনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাছুম রেজা প্রমুখ। প্রথম স্থান অর্জনকারী দল পায় গরু, দ্বিতীয় দল রেফ্রিজারেটর ও তৃতীয় দল পায় একটি খাসি।
কল্যাণ প্রসূন, জুড়ী, মৌলভীবাজার