
‘ঝুমকো জবা কানের দুল,/ উঠল ফুটে বনের ফুল।/ সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,/ ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।/ সেই দুলুনির তালে তালে,/ মন উড়ে যায় হাওয়ার তালে।’
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ‘ঝুমকো জবা’ কবিতায় কী চমৎকার করে ঝুমকা জবা ফুলের কথা লিখেছেন। ফুলটিকে কেউ কেউ ঝুমকা জবা বলে ডাকেন। কিন্তু লালমাটিয়ার একজন কস্টিউম ডিজাইনার খন্দকার সাদিয়া আফরীন ফুলটিকে ঝুমকা জবা বলতে নারাজ, তিনি এর নাম বললেন চায়নিজ ল্যানটার্ন, মানে চীনা লন্ঠন ফুল।
ফেসবুকে ফুলের ছবি দেখে প্রায় তিন বছর আগে তিনি গাছটি সংগ্রহ করেছিলেন অনলাইনে। কিন্তু সে গাছটি মরে যায়।
পরে ধানমন্ডির একটি নার্সারিতে গাছটি পেয়ে মাস ছয়েক হলো এনেছেন। লালমাটিয়ার বি ব্লকে শিমলা ভিলার সামনে টবে লাগানো গাছটিতে রোজই সকালে আট-দশটা করে এই ফুল ফোটে ও বিকেলে মিইয়ে যায়। এ সময়টুকু সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সরু সবুজ সুতার মতো লম্বা বোঁটায় বাতাসে দুলতে থাকে আলোময়ী এই ফুলগুলো। ফুল যেন ঘোমটা পরা নতমুখী লাজুক নববধূ, পাপড়ি কখনো সম্পূর্ণ খোলে না।
ফুলের পাপড়ির রং কমলা-হলুদ, শিরার মতো সরু গভীরভাবে খাঁজে খাঁজে থাকা লাল শিরার রেখা ফুলটিকে করেছে অপূর্ব রূপবতী। এর গাঢ় সবুজ পাতার সঙ্গেও জবা বা ঝুমকা জবাগাছের পাতার কোনো মিল নেই, বরং কিছুটা মিল আছে মেস্তা ও ম্যাপলগাছের পাতার সঙ্গে। পাতা গভীরভাবে পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত, প্রতিটি খণ্ডে একটি করে হালকা সবুজ মধ্যশিরা রয়েছে, পাতা দেখে মনে হয় সেগুলো যেন পাঁচ আঙুলবিশিষ্ট হাতের তালু। বয়স্ক ডালের রং ধূসর, কচি ডাল ও ডগার রং সবুজ। পাতার কোল থেকে কুঁড়ি ও ফুল ফোটে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত।
বাংলায় ঝুমকা, ঝুমকা জবা ও ঝুমকালতা নামে তিনটি ফুল আছে। বৃক্ষপ্রেমী সাদিয়া আফরীন বললেন, ফুলগুলো দেখতে ঝুমকা দুলের মতো বটে, তবে এটি ঝুমকা জবা না, ঝুমকা জবার পাপড়িগুলো চেরা চেরা, গোলাপি লাল, পাতাগুলো জবা ফুলের মতোই।
কানের দুলের মতো দুলতে থাকা ঝুমকা জবা ফুল এ দেশে প্রচুর দেখা যায়। ঝুমকা লতা ফুলের গাছ লতানো, এ ফুল আছে এ দেশে তিন রঙের—নীল ঝুমকা, লাল ঝুমকা ও বনঝুমকা। এগুলো দেখতে কানপাশার মতো। প্রথম দুটি বাগানে লাগানো হয়, শেষেরটি বনে–জঙ্গলে হয়, বুনো গাছে ফোটা সেসব ফুলের রং সাদাটে নীল, পাকা ফল শিশুরা খায়, বিষ্ঠার মতো গন্ধ বলে এ ফলকে সুন্দরবন অঞ্চলের স্থানীয়রা বলে ‘পাদ ফল’।
বাংলাদেশের উদ্ভিদ তালিকায় ঝুমকা, গন্ধ ঝুমকা, এশিয়ান ঝুমকা, ঝাম্পি ইত্যাদি বাংলা নামে যেসব ফুলের উল্লেখ আছে, সেগুলো মালভেসি গোত্রের অ্যাবুটিলন গণের বিভিন্ন প্রজাতি। এ দেশে এ গণের সাতটি প্রজাতির গাছ রয়েছে বলে উল্লেখ আছে। ফুলটিও এই গণের একটি প্রজাতি, যার নাম অ্যাবুটিলন পিকটাম, এ প্রজাতির গাছ জবা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, বরং এরা চায়না বা আমেরিকান পাটের সহোদরা।
বর্তমানে বেশ কিছু হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা পরিচিতি পেয়েছে অ্যাবুটিলন হাইব্রিডিয়াম প্রজাতি নামে। কিন্তু এ দুই প্রজাতির গাছ আমাদের দেশের উদ্ভিদতালিকায় নেই, সম্প্রতি এটি এ দেশে এসেছে।
ঝুমকার আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। ডাল কেটে বা গুটি কলম করে এর চারা তৈরি করা যায়। যেকোনো বাগানের শোভা বাড়ানোর জন্য গাছটি সুন্দর। পুষ্পপ্রেমীরা সংগ্রহ করে বিস্তার ঘটাতে পারেন।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক