সিলেটের কানাইঘাটে পাখি শিকারের জন্য পাতা জাল
সিলেটের কানাইঘাটে পাখি শিকারের জন্য পাতা জাল

থামছে না পাখি শিকার

২৯ বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে সারারাত বাসে চড়ে শীত শীত ভোরের আধো আলোতে খুলনা পৌঁছালাম। সকাল হতেই গেলাম রূপসা ফেরিঘাটে। কিন্তু ফেরির অবস্থা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল! ফেরিভর্তি মানুষ আর মানুষ। যাহোক, রূপসা ঘাটে নেমেই টেম্পো ধরে ফকিরহাট বাজারের দিকে রওনা হলাম। রাস্তা তেমন প্রশস্ত নয়। পাশাপাশি রেললাইন। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি ট্রেন দেখলাম। তবে তা এত ধীরে চলছিল যে আমাদের টেম্পোটি অনায়াসেই ওটিকে অতিক্রম করল। আমি একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনটি দূরে যেতে যেতে বিন্দুর আকার ধারণ করা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলাম।

ঘণ্টাখানেক পর ফকিরহাট বাজারে পৌঁছালাম। পক্ষিবিদ শরীফ খানের বাড়ি এখানেই। ওনার আমন্ত্রণেই এসেছি। আগে থেকেই তিনি বাজারে অপেক্ষা করছিলেন। আমরা এলে চা পর্ব শেষ করে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যানের মাছের ঘেরের দিকে রওনা হলাম। নৌকা খাল পার হয়ে কোদালিয়া বিলে পড়ল। বিলের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও পাখি দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে বিশাল এলাকাজুড়ে জাল পাতা দেখে শরীফ ভাইকে বললাম, আপনাদের এলাকায় কি এভাবে বিলের ওপর জাল শুকানো হয়? তিনি বললেন, এগুলো মাছ ধরার জাল নয়, বরং শীতের পাখি ধরার জন্য পাতা কারেন্ট জাল, যা স্থানীয়ভাবে ‘গগা’ নামে পরিচিত। এভাবেই একশ্রেণির লোক পাখি ধরে বাজারে বিক্রি করে। কোনো কোনো গ্রামের এমনকি প্রায় সব মানুষই এ কাজে জড়িত। সেখানে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার নিষিদ্ধ। কারণ, বন্দুক দিয়ে আর কয়টি পাখিই বা শিকার করা যাবে? গগায় পাখি আটকায় শত শত।

এরপর বহুদিন পার হয়ে গেছে। এখন আর বাগেরহাটে গগায় পাখি শিকারের কথা তেমন একটা শুনি না। তবে শিকার বন্ধ হয়নি। বরং ইদানীং যেন কিছুটা বেড়েছে! আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে যখন পাখি দেখা শুরু করি, তখন দেশে পাখি পর্যবেক্ষকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। আর এখন পাখি পর্যবেক্ষক ও পক্ষী আলোকচিত্রীর সংখ্যা কয়েক হাজার এবং সচেতন মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ হলেও শিকার কমছে না।

পরিযায়ী হাঁস থেকে শুরু করে বক, পানকৌড়ি, শালিক কোনো পাখিরই নিস্তার নেই। খোদ ঢাকা শহরের পাখিরাই যেখানে রক্ষা পাচ্ছে না, সেখানে প্রান্তিক অঞ্চলের কথা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। দেশি পদ্ধতিতে ঘুঘু, কোড়া, কালেম, ডাহুক আর বক শিকার তো সারা বছরই চলছে। তার সঙ্গে শীতে বিষটোপ দিয়ে পরিযায়ী হাঁস ও জলার পাখি শিকার হচ্ছে পুরো দেশে। সিলেট থেকে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের সব জায়গাতেই শিকারিরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। সিলেট অঞ্চলে শীত এলেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে পরিযায়ী পাখির মাংস খাওয়ার ধুম পড়ে। বিষটোপে মরা পাখি খেয়ে কি মাংসলোলুপ অসচেতন মানুষেরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে না?

গত বছর সিলেটের কানাইঘাট গিয়ে পাখিপ্রেমী শামীম খানের সঙ্গে পরিচয়। উনি আমাদের কানাইঘাটের হাওর-বিলে পরিযায়ী পাখি দেখাতে নিয়ে গেলেন। তখনই তিনি সিলেটে ব্যাপক হারে পাখি শিকারের কথা বললেন। বন বিভাগ ও প্রশাসনের সাহায্য নিয়েও থামানো যাচ্ছে না পাখিশিকারি, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ও পাখির মাংসলোলুপ মানুষদের। শামীম ভাইয়ের তথ্যমতে, গত তিন মাসে সিলেটের হরিপুর–সংলগ্ন বড় হাওরে বন্দুক দিয়ে প্রচুর শিকার হয়েছে। এ ছাড়া বিষটোপ এবং গগা (জাল পেতে শিকার) তো আছেই। উনি কিছু পাখিপ্রেমী নিয়ে সিলেটের আশপাশে শিকার বন্ধের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচিত বহু পাখিপ্রেমী ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে শিকার বন্ধের চেষ্টা করেযাচ্ছেন। কিন্তু কোনোভাবেই পাখি শিকার কমছে না।

পোষা বক দিয়ে বুনো বক শিকার। পেছনে ঘাস-পাতার ডেরায় লুকিয়ে আছে শিকারি

কাজেই এখন সারা দেশ থেকে একসঙ্গে প্রতিরোধের সময় এসে গেছে। তা না হলে নানা কারণে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হতে থাকা এ দেশের নড়বড়ে প্রকৃতি এবার একবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তা একসময় আমাদেরই ক্ষতির কারণ হবে। কাজেই এখনই যদি প্রকৃতি ও পাখি তথা বন্য প্রাণীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছ থেকে অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই পাব না। অতএব যেকোনো মূল্যে পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। এ জন্য সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন এনজিও, মিডিয়া এবং আপামর জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ব্যাপকভাবে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

১২ ডিসেম্বর ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়াসংলগ্ন নিউভিশন ইকোসিটি এলাকায় পাখি পর্যবেক্ষক, আলোকচিত্রী ও প্রশাসন সমন্বয়ে পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক এক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল, যা জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। কাজেই এ ধরনের উদ্যোগ পুরো শীতে দেশব্যাপী গ্রহণ করতে পারলে আশা করি মানুষ সচেতন হবে। পাখি শিকার কমতে কমতে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও পাখিসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখিবন্য প্রাণী প্রজননচিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়