শৈশবের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে, আমাদের পাড়ায় কলেজপড়ুয়া এক বড় আপা ছিল, তার কণ্ঠের জাদু পুরো জেলায় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে সবাই একবাক্যে স্বীকার করত, একদিন সে সত্যিই বড় শিল্পী হবে। বিভাগীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অনুষ্ঠানেই সে অংশ নিত।
পড়াশোনা ও গানের অনুষ্ঠানের কারণে অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় সে বেশি ব্যস্ত সময় পার করত। সমাদরও অন্যদের চেয়ে বেশি পেত। এ সময় মেয়েটি পাশের বাড়ির ‘সম্ভ্রান্ত সুশীল’ পরিবারের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়া যোগ্য ছেলের প্রেমে পড়ল। সুশীল পরিবারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, ছেলের বাবা কিছুতেই এই গানবাজনা করা মেয়েকে পূত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে রাজি নন। জেদি ছেলেটিও কিছুতেই ভালোবাসার মানুষকে ছাড়তে রাজি নন। মহল্লাবাসীও সব ছেড়ে এই দ্বন্দ্বে শামিল হলো। কেউ ছেলের পক্ষ নিল, কেউ মেয়ের। অবশেষে ছেলের জেদের কাছে হার মেনে রাজি হলেন বাবা, তবে শর্ত একটাই-গান ছাড়তে হবে। কোথাও কোনো অনুষ্ঠানেও আর গাইতে পারবে না মেয়ে।
বিয়ে হয়ে গেল। এরপর কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া তো দূরের কথা, আপাকে আর গুনগুন করতেও দেখা যায়নি। পাড়ার সমজদার লোকেরা কিছুদিন কানাঘুষা, হা-হুতাশ করল, তারপর সবাই বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেল। কারণ, সমাজে সৃজনশীল মানুষের অপরিহার্যতা বিষয়ে এ দেশের মানুষের মন সব সময় দোদুল্যমান ছিল। তাই মানুষ ভাবল, যা হলো, হয়তো ভালোই হলো।
তবু পেছনপানে যদি তাকাই, ৯০-এর দশকের শুরুর দিকে যে মফস্সল আমি চিনতাম, তার চেহারা কিছুটা ভিন্ন ছিল। কিছু শান্ত অবস্থা মানুষের মধ্যে বিরাজমান ছিল। আমরা মেয়েরা খুব ভোরে মাথায় লম্বা ওড়না টেনে, ছেলে শিশুরা মাথায় টুপি দিয়ে, হাতে আমপারা নিয়ে লাইন করে পাড়ার নানির কাছে কোরআন শিখতে যেতাম। আর সন্ধ্যাবেলায় হারমোনিয়াম নিয়ে সারগাম করতাম। পাড়ার মানুষ শুনত আর জানত, এই মহল্লায় কোন ছেলে বা মেয়ে ভালো গান গায়। পরিবারে ও সমাজে সংস্কৃতিচর্চার একটা ঝোঁক ছিল। সে সময় মফস্সল শহরগুলোয় ভালো শিল্পী হলে তাকে আশপাশের সবাই চিনত, সুনাম করত। বাড়ি বাড়ি তাই সকাল-বিকেল হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যেত। কেউ না কেউ কোথাও হারমোনিয়াম নিয়ে বসে তালিম করছে, ছবি আঁকছে। সদ্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে মঞ্চনাটক, আবৃত্তির দল করছে। সমাজ ও দেশ নিয়ে আলাপ করছে। সমাজসংস্কারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছে। আমরা ছোটরা তাদের মতো হতে চাইতাম। এখন নিজের সেই মহল্লায় বা কাজের সুবাদে অন্য শহর, যেখানেই যাই, মনে পড়ে না, কবে একটা হারমোনিয়ামের শব্দ শুনেছি।
বড় হয়ে বুঝেছি, আমাদের সমাজে সব সময় সৃজনশীল সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে ‘অসম্মান’ শব্দটা যুক্ত ছিল। কিন্তু এর ভেতরেই শৈশবে আমাদের গান, আবৃত্তি, নাটকের চর্চা চলেছিল। আমাদের পাড়াতো বড় আপার বিয়ের মধ্য দিয়ে সংগীতচর্চার অবসান যখন হলো, আমরা তখন বুঝিনি, একদিন আমাদের সবার পরিস্থিতিই এক হবে; হয় গানবাজনা, নাটক; না হয় ‘সম্মান’—
একটাকে বেছে নিতে হবে। আমার শৈশবের বন্ধুরা তাই সবাই সম্মানের পথ বেছে নিল। কেউ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, গৃহিণী, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষকতার পথ ধরল…আমি বেছে নিলাম অসম্মানের পথ, পড়াশোনা শুরু করলাম নাটকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে ভর্তি হয়ে বুঝতে পারলাম যে এই পড়ালেখার কোনো দাম নেই। ভর্তিপ্রক্রিয়াও তা-ই। যারা আর কোনো বিষয় পায় না, তারা পড়বে এই সব: নাটক, সংগীত ইত্যাদি। নিরক্ষর মানুষ এই নিয়ম তৈরি করেনি। বুদ্ধিজীবীরা অনেক মেধা অপচয় করে এই নিয়ম বানিয়েছেন। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে অবহেলিত-উপেক্ষিত বিষয় থিয়েটার, সংগীত, ফিল্ম, নৃত্য। এ যেন পরিবারের সবচেয়ে দরিদ্র ‘আনকালচারড’ খালা বা চাচার পরিবার, যাদের পাতে নেওয়া যায় না, আবার ফেলাও যায় না। কিন্তু এই বুদ্ধিজীবীদের মাথায় কখনো কেন এই প্রমাণিত সত্য ধরা দেয় না যে একজন সত্যিকারের সৃজনশীল মানুষের মেধার তুলনা কারও সঙ্গে চলে না। হাজার হাজার মেধাবী চিকিৎসক হতে পারেন, কিন্তু সব চিকিৎসক আন্তন চেখভ হবেন না। সব ইঞ্জিনিয়ার বাদল সরকার হন না, সচিব হওয়ার মেধা থাকলেই সবাই শহীদুল জহির হন না। সব সৃজনশীল মানুষই আবার তাঁর কাজ দিয়ে মেধা, দিয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেন না, কিন্তু একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী তৈরিতে সব সৃজনশীল মানুষের কাজের পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। রাষ্ট্র ও সমাজের এই বৈষম্যমূলক আচরণ সেই পথকে ব্যাহত করছে। সৃজনশীল শিল্পের প্রতি এই বৈষম্য, তুচ্ছতাচ্চিল্য চিরকালের। একদিকে রাষ্ট্র সব সময় শিল্পীদের ভয় পেয়েছে। দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। অন্যদিকে শিল্পীদের অনিশ্চিত জীবন, কট্টরপন্থীদের আগ্রাসন, হুমকি-ধমকি সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্পপ্রীতি কমিয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে শিল্পচর্চার অবস্থান কী, তা এখন পরিষ্কার। এর আসল চেহারা যেন কঙ্কালসমেত ফুটে উঠেছে। একদিকে বিগত বছরগুলোয় রাষ্ট্রের ছায়াতলে গজিয়ে ওঠা ক্ষমতার পক্ষে কথা বলা সুবিধাভোগী শিল্পীরা, যাঁরা হা-হুতাশ করছেন, ডুব দিয়ে আছেন, কী করে পরিস্থিতি আরও ঘোলা করে ফায়দা নেওয়া যায়; অন্যদিকে চাপা দিয়ে রাখা কট্টর উগ্র ইসলামপন্থীরা, তলে তলে যাঁরা গড়ে উঠেছেন, তাঁরা মাথা বের করছেন। তাঁরা এখন নোংরাভাবে প্রকাশ্যে সংস্কৃতিচর্চাকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। স্কুলে সংগীত শিক্ষকের পদ তাঁরাই গিলতে চাচ্ছেন। নানা শঙ্কায় ঘরে বসে গেছেন ভীত-সন্ত্রস্ত শিল্পীরা।
কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রে একটা বিপ্লব হওয়ার কথা ছিল। মন খুলে গানে, নাটকে, কবিতায় মানুষের কথা বলার কথা ছিল। সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নিজেদের শিল্পের ভাষা খোঁজার কথা ছিল। আমাদের জীবনযাপনের যে সংস্কৃতি এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে, তার শিকড় খুঁজে বের করে, নতুন শিল্পপরিচয় তৈরি করার কথা ছিল। কয়েক মাস এ বিষয়ে আলোচনাও চলেছিল। কিন্তু আশ্চর্য! এই সময়ে এসে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সব জায়গায় কেবল চাপা উদ্বেগ ও হতাশা। যেন উত্তরণের কোনো পথ নেই। কাজ নেই, আলোচনা নেই। অধিকাংশ শিল্পী সুদিনের আশায় ঘরে বসে গেছেন। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে উঁকি দিচ্ছেন আর কাজ না করে হতাশা ঝাড়ছেন, অপেক্ষা করছেন, কবে ভালো দিন আসবে, বুঝেশুনে পা বাড়াবেন। কট্টরপন্থীদের নানা রকম বাধা, হামলা, নয়তো সরাসরি আক্রমণ চলছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এর কোনো প্রতিকার নেই। রাষ্ট্র বরাবরের মতো একই ভূমিকা পালন করছে। সবচেয়ে অবহেলিত সৃজনশীল খাত। নামেমাত্র বাজেট বাড়ানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের একহাজার ভাগের এক ভাগও নয়। শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় অকেজো করে রাখা হয়েছে। লুটপাট চলছে। যে নতুন বাংলাদেশে কথা বলার স্বাধীনতা থাকার কথা ছিল, সেখানে হল বরাদ্দ না দিয়ে সূক্ষ্মভাবে কিছু নাটকের ওপর নিষেধাজ্ঞাও চলছে। নতুন কোনো উদ্যোগ নেই। ভালো কোনো শিল্প সৃষ্টিতে রাষ্ট্রের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো সদিচ্ছা নেই। মফস্সলে, গ্রামে-গঞ্জে নতুন প্রজন্মকে সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই।
রাস্তায় চলি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখি। একটা অভিব্যক্তি, কামড়াকামড়ি, রাগ, হিংস্রতা-বাংলাদেশের মূল স্পন্দন এখন এ-ই। আমাদের অস্তিত্বগত উদ্বেগ প্রকাশে এডভার্ড মুঙ্কের চিত্রকর্ম ‘দ্য স্ক্রিম’ অনেক পেছনে পড়ে গেছে। কারণ, আমাদের অস্তিত্বগত উদ্বেগ এখন আরও ভয়ংকর, বীভৎস। সারা বাংলাদেশেই একই রকম বোধ। যে দেশ জারি, সারি, ভাটিয়ালির, সেখানে যেন কোনো লাবণ্য নেই, কোনো কমনীয়তা নেই, কোনো সুর নেই। শিশু-কিশোরেরা হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। নেশাদ্রব্য গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাদা আর কালোর বাইরে আর কিছু এরা চিনছে না। মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। উদ্বেগ আর বিষাদ মানুষকে গ্রাস করছে। নিজের মতামতে আমরা প্রত্যেকেই কট্টর মৌলবাদী। জাতিগতভাবে আমরা এই জায়গায় কী করে দাঁড়ালাম? রাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিচ্ছে মানবিক উন্নয়নে? জীবনযাপনের উন্নয়নে? এই জানা কথাগুলো বলা জরুরি। কারণ, আমাদের জীবনধারণের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে আর আমাদের সৃজনশীল সংস্কৃতিচর্চা, তা একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা চিন্তা করলে চলবে না। আর কোনো পথ খোলা না থাকলে নতুন প্রজন্ম সিরাজগঞ্জের যুবকের মতোই হিংস৶ হয়ে উঠবে, নিজের দাদির মতো কোনো আপনজনের কল্লা নামিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। কারণ, আমরা সুদিনের অপেক্ষায় থাকলেও স্বার্থলোভীরা কাজ করে যাচ্ছে, কোমল মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাচ্ছে। খেয়ে শেষ করবে।
সারা পৃথিবীতে শিল্পের পথ কখনো মসৃণ ফুলবিছানো ছিল না, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলয়ের ছায়াতলে থেকে কোনো কালে কোনো শিল্পী বা শিল্পকর্ম মহান হয়ে ওঠেনি। যখন আর কোনো উপায় নেই, তখন শিল্পীদের নিজেদের চেষ্টায় নানা উপায়ে এ সময় চতুর্গুণ কাজ করা দরকার। যত বাধা আসবে, তার দ্বিগুণ উপায় বের করা প্রয়োজন—সম্মিলিতভাবে। কারণ, এটা অস্তিতের লড়াই। আর এটা প্রমাণিত যে দুর্বলেরা লড়াইয়ে টিকে থাকে না। তাই হে বন্ধু, হে আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না…
মহসিনা আক্তার: অভিনয়শিল্পী ও নির্দেশক, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, স্পর্ধা