
রাজধানীর হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ছিল ভীতি আর বিভাজন সৃষ্টি এবং দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের অপচেষ্টা। ৯ বছর আগের ভয়াবহ ওই হামলায় সাহসী যে মানুষগুলো প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের যেন ভুলে না যাই। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ যাতে আবার মাথাচাড়া না দেয়, সে ব্যাপারে আমাদের সব সময় সজাগ থাকতে হবে।
গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানাতে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানে ইতালির রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অতিথিরা এ কথাগুলো বলেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্মরণ অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। শুরুতে ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো হোলি আর্টিজান বেকারির সামনে না করে তাঁর বাসায় অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, আগামী বছর এ জঙ্গি হামলার এক দশক পূর্তিতে হোলি আর্টিজান বেকারির সামনে স্মরণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করা হবে।
এরপর হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানস্থলে একটি নামফলকের সামনে ইতালি, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে ফারাজ আইয়াজ হোসেনের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন এবং বাংলাদেশ পুলিশ ও ঢাকায় অবস্থানকারী প্রবাসী ইতালীয়দের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতিনিধিরাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম বলেন, ‘২০১৬ সালের এই দিনে এক নিষ্ঠুর হামলা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারির শান্ত পরিবেশকে চুরমার করে দিয়েছিল। আজ আমরা শুধু সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে নয়, বরং সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত লড়াইয়ের প্রতি অটল অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতেও একত্র হয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘হোলি আর্টিজান হামলা ছিল আমাদের অভিন্ন মানবতার প্রতি এক নিষ্ঠুর আঘাত। এটি ছিল আমাদের প্রাণবন্ত, সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কেন্দ্রে ভয় ও বিভাজন ছড়িয়ে দেওয়ার এক দুঃসাহসিক অপচেষ্টা।’
ওই হামলায় নিহত নিরীহ ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘ভয়াল সেই রাতের মুখোমুখি হয়ে অসাধারণ সহনশীলতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সাহস ও সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে জবাব দিয়েছিল। সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে তাঁদের দুজন শহীদ হয়েছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘সেই মর্মান্তিক দিনের পর আমরা একটি জাতি হিসেবে অনেক দূর এগিয়েছি। বাংলাদেশ উগ্রবাদ মোকাবিলায় ও সন্ত্রাসবিরোধী সক্ষমতা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা একটি বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করেছি।’
আসাদ আলম বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) নীতি” অনুসরণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা আরও সুদৃঢ় করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
অনুষ্ঠানে ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো বলেন, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ যাতে আবার মাথাচাড়া না দেয়, সে ব্যাপারে আমাদের সব সময় সজাগ থাকতে হবে। এটাও অনস্বীকার্য যে যাঁরা মনে করে থাকেন, এ ধরনের জঙ্গি হামলার মাধ্যমে স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশিদের, মুসলিমদের সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশের মধ্যে বিদ্বেষ বা ঘৃণা ছড়াতে চান, তাঁরা কিন্তু সফল হবেন না। কারণ, আমাদের বন্ধুত্ব আর অংশীদারত্ব ক্রমেই শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের অঙ্গীকার জোরালো হয়েছে।’
ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক লুইগি ভিগনালি বলেন, ‘সাহসী যে মানুষগুলো ৯ বছর আগে প্রাণ দিয়েছিলেন, আমরা যেন তাঁদের ভুলে না যাই। সন্ত্রাসবাদ যাতে বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বের কোথাও মাথাচাড়া না দেয়, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
স্মরণ ও শ্রদ্ধা নিবেদনের এ আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন ওই ঘটনায় নিহত ইতালি ও জাপানের নাগরিকদের পরিবারের সদস্য, নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মা ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা, জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নৃশংস হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। কুপিয়ে, গুলি করে তারা দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইতালির নাগরিক ছিলেন নয়জন, জাপানের সাতজন, ভারতের একজন ও বাংলাদেশি তিনজন। সেই রাতে জিম্মিদের মুক্ত করতে অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। ভয়াবহ এই জঙ্গি হামলায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে পুরো দেশ।