সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি– ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর)
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি– ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর)

সহকর্মী অধ্যাপকদের মূল্যায়ন

ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় অসামান্য দখল ছিল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের

চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা, প্রিয়জনদের প্রার্থনা সত্ত্বেও জীবনের আলোকিত পথে আর ফিরলেন না দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক। আজ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র, আত্মীয়স্বজন ও দেশ–বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ৩ অক্টোবর সকালে ধানমন্ডিতে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) যাওয়ার পথে গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গাড়িচালক তাঁকে পার্শ্ববর্তী একটি হাসপাতালে নেন। খবর পেয়ে অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামসহ অন্যরা সেখান থেকে তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছে। পরে সেখানে তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রে স্টেন্টিং করা (রিং পরানো) হয়।

গত শনিবার থেকে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে, ফুসফুসে পানি জমার কারণে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে রোববার সন্ধ্যায় লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। পরে আবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পুনরায় লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। আজ বিকেল পাঁচটায় চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পাঙ্গনে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক, আধুনিক মানসিকতাসম্পন্ন প্রতিভাবান মানুষ। তাঁর লেখায়, চিন্তায় এর প্রকাশ ঘটেছে। যেকোনো সংকটকালে তিনি স্পষ্ট কথা বলতে পারতেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মরদেহ নেওয়া হচ্ছে বারডেমে। আজ সেখানকার হিমঘরে রাখা মরদেহ। ল‍্যাবএইড হাসপাতাল, ঢাকা

অশীতিপর বয়সে পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্ত্রী সিদ্দিকা জামান। তিনি বললেন, ‘ওর অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই প্রতিদিন সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছি। বহুদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল আমাদের পরিবারের সঙ্গে। খুব দুঃখ পেয়েছি, শেষ দেখা হলো না।’

তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী অধ্যাপক ফখরুল আলম ও অধ্যাপক কায়সার হক এসেছিলেন হাসপাতালে। তাঁরা বললেন, অসাধারণ রসবোধ ছিল তাঁর। সাবলীল পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতেন। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় অসামান্য দখল ছিল তাঁর। শিল্পকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র বহু বিষয়ে তাঁর গভীর জানাশোনা ছিল। তিনি চলে যাওয়ায় আরও গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হলো।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু বললেন, ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর তিনিই বেঙ্গলের বহু কাজে হাল ধরেছিলেন। তাঁর চলে যাওয়া আমাদের কাছে বিপুল ক্ষতি।’

হাসপাতালে আরও এসেছিলেন কবি দিলারা হাফিজ, ফরিদ কবির, মারুফুল ইসলাম, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কথাশিল্পী ও চিকিৎসক মোহিত কামাল, বরেণ চক্রবর্তীসহ আরও অনেকে। এ ছাড়া মাজহারুল ইসলামসহ অন্যদিন পরিবারের পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন সকাল থেকেই। তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী ও গুণগ্রাহী এসেছিলেন প্রিয়জনের প্রস্থানে ব্যথিত চিত্তে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর মরদেহ ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে বের করে আনা হয়। উপস্থিত স্বজনেরা তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। মরদেহ ফ্রিজিং ভ্যানে করে বারডেমে নিয়ে যাওয়া হয়।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কাজের গুরুত্ব নিয়ে সংক্ষেপে কথা বলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। ল‍্যাবএইড হাসপাতাল, ঢাকা

শোক

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান। শোক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মনজুরুল ইসলাম দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্য অবদান রেখে গেছেন। এ অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মরদেহ রাতে বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। আগামীকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে নেওয়া হবে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এখান থেকে বেলা ১১টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে। পরে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের ওপর পিএইচডি করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের পর তিনি ইউল্যাবে যোগ দেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন, যাতে বাস্তব ও অবাস্তবের তফাত ঘুচে জাদুবাস্তবতার স্পর্শে সামান্য ঘটনাও অসামান্য হয়ে ওঠে। তাঁর প্রেম ও প্রার্থনার গল্প বাংলা ১৪১১ সালে (২০০৫ সাল) প্রথম আলো বর্ষসেরা সৃজনশীল বইয়ের পুরস্কার পায়। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৮ সালে একুশে পদক পান। সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়েও তাঁর বই রয়েছে।