
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সাল হচ্ছে সবচেয়ে ঝঞ্ঝাপূর্ণ বছরের একটি। এর মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বাঁকবদলের মাস ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর। এই অস্থির সময়, বিশেষ করে ৩ থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, অন্য কোনো সময় নিয়ে তত হয়নি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিপরীতে ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাল্টা আরেকটি অভ্যুত্থান। এ সময়ের নানা স্মৃতি, দলিল ও মতামত নিয়ে থাকছে প্রথম আলোর এই বিশেষ আয়োজন।
১৯৭৫ সালে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে কর্নেল শাফায়াত জামিল ছিলেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গী। এর ফলে ৬ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। আজ প্রকাশিত হলো কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রমের সেই লেখাটি।
১৫ আগস্টের পর থেকেই অভ্যুত্থানকারী খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার একটা চিন্তা কাজ করছিল আমার মধ্যে। সমমনা কিছু অফিসারের মৌন সমর্থনও আমার পেছনে ছিল জানতাম। ১৯ আগস্ট সেনা সদরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে ফারুক ও রশিদের উপস্থিতিতে আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করি যে দেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। অবৈধ খুনি রাষ্ট্রপতি মোশতাককে আমি মানি না এবং প্রথম সুযোগেই তাকে আমি পদচ্যুত করব। অফিসারদের অনেকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার তাগিদ ও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছিলেন আমাকে। সেনা আইনে এগুলো গর্হিত অপরাধ। কিছু একটা করতে চাইছিলাম। কিন্তু পক্ষ-বিপক্ষ চেনা ছিল মুশকিল তখন। তবে বুঝতে পারছিলাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও অন্যান্য শৃঙ্খলাপরায়ণ ও নীতিমান কিছু অফিসারের সমর্থন আমি পাব।
অক্টোবরের শেষার্ধে সেনাবাহিনীর প্রমোশন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য মেজর র্যাঙ্কের অফিসারদের যোগ্যতার ভিত্তিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যাঙ্কে প্রমোশন দেওয়া। রশিদ, ফারুক ও ডালিমের নামও এই বোর্ডে উপস্থাপিত হয় বিবেচনার জন্য। প্রমোশনের পরিবর্তে তাদের বিচারের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করি আমি। আমাকে সমর্থন দেন তৎকালীন বিডিআরপ্রধান মেজর জেনারেল কিউ জি দস্তগীর, ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত এবং কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল আমজাদ আহমেদ চৌধুরী। দুঃখের বিষয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আমাদের বিরোধিতা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়।
অক্টোবরের ২৮-২৯ তারিখ হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, ‘কিছু কি ভাবছ? এ পরিস্থিতিতে দেশ ও আর্মি চলতে পারে না। জিয়া এগিয়ে আসবে না। ডু সামথিং।’ ব্রিগেডিয়ার খালেদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনীপ্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের আলাপ হয়েছিল এ ব্যাপারে। খালেদ আমার মত চাইলেন। আমি বললাম, ‘আপনি দিন-তারিখ বলেন। আমি প্রস্তুত।’
১ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও আমি খালেদের অফিসে বসলাম। বিস্তারিত আলোচনার পর খালেদ সিদ্ধান্ত দিলেন, ২ তারিখ দিবাগত রাত ২টায় বঙ্গভবনে মোতায়েন আমার দুটো কোম্পানি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসবে, সেটাই হবে অভ্যুত্থান শুরুর ইঙ্গিত।
পরিকল্পনামতো রাত তিনটায় বঙ্গভবনে মোতায়েন প্রথম বেঙ্গলের কোম্পানি দুটো চলে এল। আমার স্টাফ অফিসারগণ, মেজর নাসির, মেজর ইকবাল, মেজর মাহমুদ এবং এমপি অফিসার মেজর আমিন অভ্যুত্থান শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান জিয়াকে ১৫ আগস্টের খুনি, বিদ্রোহকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গলের এক প্লাটুন সেনা পাঠানো হলো তাঁকে নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রাখতে। মেজর নাসির ও মেজর আমিনকে পাঠালাম ট্যাংকবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। নাসির ট্যাংকবাহিনীর অফিসার ছিল বলে সুবিধা হবে ভেবে তাকেই পাঠাই। এর আগে আমি একদিন ট্রুপস পরিদর্শনে গেলে রেডিওতে মোতায়েন গোলন্দাজ বাহিনীর কোনো কোনো অফিসার আমাকে সমর্থনের আভাস দিয়েছিলেন, সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
কিন্তু ট্যাংকবাহিনীতে গিয়ে মেজর নাসির ও মেজর আমিনের অভিজ্ঞতা হলো উল্টো। উদ্দেশ্য শুনে তাদের বন্দী করে ফেলা হলো। বঙ্গভবন থেকে ফারুক তাদের মেরে ফেলার হুকুম জারি করল। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁকে প্রটেকটিভ কাস্টডিতে এনে নিষ্ক্রিয় করে ফেলল। তাঁর বাসার টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো।
টিভি ও রেডিওতে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির যে অফিসাররা অবস্থান করছিল, তারা আমার নির্দেশে ঠিক দুইটায় ফারুক-রশিদের আনুগত্য ত্যাগ করে রেডিও-টিভি বন্ধ করে দেয়। আমার ওসি সিগন্যাল কোম্পানির মেজর মুসা কেন্দ্রীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। সেনা সদরের মেজর লিয়াকত (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) এ ব্যাপারে তাকে পুরো সহযোগিতা করে। বঙ্গভবনে মোতায়েন বিদ্রোহীদের ট্যাংক আক্রমণের চেষ্টা করলে তাকে প্রতিহত করার জন্য সোনারগাঁও হোটেলের ক্রসিংয়ে পাঠানো হলো এক কোম্পানি সৈন্য। এক কোম্পানি পাঠানো হলো সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়েও। এই কোম্পানি দুটো ছিল প্রথম বেঙ্গলের। ৩ তারিখ সকাল আটটার মধ্যে এরা অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ক্যান্টনমেন্টস্থ ট্যাংক রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার থেকে যাতে হামলা করতে না পারে, সে জন্য দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুই কোম্পানি গেল রাস্তা বন্ধ করতে।
চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসারের অফিসে আমাদের থাকার কথা ছিল রাত দুইটায়। আমি দুইটা থেকে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করি। কিন্তু খালেদ মোশাররফ বা নুরুজ্জামান কারোরই দেখা নেই। এত দিন অন্য যাঁরা প্রতিনিয়ত বলতেন কিছু একটা করার জন্য, তাঁদেরও দেখা নেই। দীর্ঘ রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর খালেদ মোশাররফ এলেন শেষরাত চারটার দিকে।
ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান এসেছিলেন সকালে। ততক্ষণে হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটার আকাশে। যাহোক, আমরা গুটিকয় লোক যখন অসীম উৎকণ্ঠার মধ্যে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছি, শুনতে পেলাম দ্বিতীয় বেঙ্গলের সিও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবশ্য তাঁর বদলে তাঁর অধীন ক্যাপ্টেন নজরুল দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়। সিও সাহেব বোধ হয় ভোরবেলা আকাশে হেলিকপ্টার আর মিগ দেখে আশ্বস্ত হন যে সাফল্য আমাদের নিশ্চিত। তিনি সকাল হয়ে যাওয়ার পর এসে হাজির হন এবং অতি উৎসাহ দেখাতে থাকেন।
যাহোক, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। ২ তারিখ মধ্যরাতে স্কোয়াড্রন লিডার ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পর্যায়ের ১০ অফিসার আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্টে রাতে জঙ্গি বিমান ওড়ানোর সুবিধা ছিল না। তবে বিমানবাহিনীর অফিসাররা কথা দিলেন, ফার্স্ট লাইটে অর্থাৎ কাকডাকা ভোরেই তাঁরা বিমান ওড়াবেন। তাঁরা তাঁদের কথা রেখেছিলেন। ভোরে তাঁরা একটি হেলিকপ্টার ও একটি ফাইটার যথাসময়ে আকাশে উড়িয়েছিলেন, যা দেখে বিদ্রোহীরা হতভম্ব হয়ে যায়। বিমানবাহিনীর এই অসমসাহসী অফিসাররা মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের বিমান আর হেলিকপ্টারগুলো শান্তিকালীন অবস্থান থেকে যুদ্ধকালীন সশস্ত্র অবস্থানে রূপান্তর করে কাকডাকা ভোরে ফাইটার প্লেন এবং হেলিকপ্টার উড়িয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের এই ক্ষিপ্রতায় হতভম্ব ও হতাশ হয়ে ১৫ আগস্টের খুনিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত, বদরুল আলম, জামাল এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশিদ, সালাহউদ্দীন, ওয়ালী, মিজান এবং ফ্লাইং অফিসার কাইয়ুম ও ফরিদুজ্জামান সেদিন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ বিমানের একজন বৈমানিক ক্যাপ্টেন কামাল মাহমুদও আমাদের পক্ষে সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ভোর হতে না হতেই চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসে আমরা যে হেডকোয়ার্টার করেছিলাম, সেখানে প্রচুর অফিসার এসে সমবেত হলেন আমাদের সমর্থনে। অসংখ্য অফিসারের মধ্যে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীপ্রধানও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবাহিনীতে আমাদের সমর্থক অফিসাররা যেসব ফাইটার হেলিকপ্টার আকাশে উড়িয়েছিলেন, সেগুলো সারা দিন পর্যায়ক্রমে বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে অবস্থিত ট্যাংকবাহিনী ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপর (যেখানে কিছু বিদ্রোহী সেনা ও ট্যাংক ছিল) বিমান আক্রমণের মহড়া চালায়। কোনো ট্যাংক বিন্দুমাত্র মুভ করা মাত্রই সেগুলোর ওপর আঘাত হানার জন্য তৈরি ছিলেন বিমানবাহিনীর অকুতোভয় পাইলটরা। তাঁরা আমার কাছে বারবার অনুরোধ করছিলেন এয়ার স্ট্রাইকের অনুমতি চেয়ে। কিন্তু খালেদ মোশাররফ ও আমি এ সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম, ভ্রাতৃহত্যার কোনো প্রয়োজন নেই।
সকাল আটটা নাগাদ রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল হুদা টেলিফোনে আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। কর্নেল হুদা বলেন, আমাদের প্রয়োজনে যেকোনো সাহায্য করতে তিনি প্রস্তুত আছেন। এরপর সারা দিনই তিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
নারী, শিশুসহ নিরস্ত্র ব্যক্তিদের হত্যাকারীরা সব সময়ই কাপুরুষতার পরিচয় দেয়। প্রতিরোধের সাহস তাদের থাকে না। এ ক্ষেত্রে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা একরকম বিনা প্রতিরোধেই আত্মসমর্পণ করে। তাদের পরাভূত করতে একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি। টেলিফোন যুদ্ধেই পরাজয় মেনে নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে তারা।
৩ তারিখ ভোর থেকে শুরু হয় ১৫ আগস্টের হত্যাকারী বিদ্রোহী অফিসার তথা ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোন যুদ্ধ। আমাদের দিকে খালেদ মোশাররফ এবং ওদিকে পর্যায়ক্রমে রশিদ, জেনারেল ওসমানী এবং সর্বোপরি খন্দকার মোশতাক। দুপুরের পর আমাদের পক্ষ থেকে একটি নেগোসিয়েশন টিম পাঠানো হয় বঙ্গভবনে ৩-৪ জন অফিসারের সমন্বয়ে। খুনিরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা সংঘাতের পথ বেছে নেয়। প্রথমে তারা গরম-গরম কথা বললেও সারা দিন হেলিকপ্টার ও মিগের মহড়া দেখে ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশত্যাগের জন্য সেফ প্যাসেজ-এর অঙ্গীকার দাবি করলেন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। এ সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে বিদেশে চলে গেলেও প্রয়োজনে পরে ইন্টারপোলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে। ঠিক হলো, ফারুক-রশিদকে ব্যাংকক পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বিমানবাহিনীর প্রধান এম জি তাওয়াব।
ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে বাগ্যুদ্ধ যখন চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানি না জেলে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ওই বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ওই ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তাঁরা আমাদের কিছুই জানাননি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে যেতে দেওয়া হতো না।
ইতিমধ্যে বেলা দুইটার দিকে জিয়া তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন। তিনি আমাকে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠান। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য সেটা হতো কিছুটা বিব্রতকর। জিয়ার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ‘৭১-এ একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি আমরা। সব মিলিয়ে আমি একটু বিব্রতকর অবস্থায় ছিলাম বলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। তবে জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার ভার আমার ওপর ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার পর জিয়াকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি করে পাঠিয়ে দেব। ৩ তারিখ রাত ১১টায় খুনিচক্র ব্যাংকক অভিমুখে রওনা হয়। ঢাকা থেকে ওড়ার পর রিফুয়েলিংয়ের জন্য তারা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একবার নেমেছিল।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্রের সেনা অফিসাররা প্রায় সবাই ব্যাংকক চলে যায়, তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনকে সম্ভবত কৌশলগত কারণে দেশে রেখে যাওয়া হয়। এই অফিসার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে একটি আর্টিলারি গান দিয়ে সরাসরি ৭-৮ রাউন্ড ফায়ার করেছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট ওই গোলায় মিরপুর এলাকায় কয়েকজন বেসামরিক লোক হতাহত হয়। ৭ নভেম্বর রাতে এই মেজর মহিউদ্দিনই তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে জিয়াকে মুক্ত করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে নিয়ে আসে।
৪ নভেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গলের হেডকোয়ার্টারে এলেন। তাঁদের মুখেই প্রথম শুনলাম জেল হত্যাকাণ্ডের কথা। এ ঘটনার কথা শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের আগপর্যন্ত কয়েক দিনের জন্য মোশতাককে স্বপদে বহাল রাখতে চেয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ, যা আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সব দিক বিবেচনা করে মেনে নিই। জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় এভাবে হত্যা করার কথা শুনে আমি খালেদ মোশাররফকে বললাম, মোশতাককে এখনই অপসারণ করুন আপনি।
১১টার দিকে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে গেলেন, যেখানে মোশতাক তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। আমি হেডকোয়ার্টারে রইলাম সারা দিন। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বসে আছি। চারদিকে নানান গুজব, নানান আশঙ্কা। অফিসারদের অনেকেই বেশ উত্তেজিত। তাঁরা বলছেন, এই যদি হয়, তাহলে অভ্যুত্থান কেন করলাম আমরা!
ছয়টার দিকে তিনজন অফিসারকে নিয়ে বঙ্গভবনে গেলাম আমি। গিয়ে দেখি রাষ্ট্রপতির সেক্রেটারির রুমে খালেদ মোশাররফ, তাওয়াব ও এম এইচ খান আলাপ করছেন। দেখে মনে হলো, বেশ হালকা মেজাজেই আছেন তাঁরা। বঙ্গভবনে তখন ক্যাবিনেট মিটিং চলছিল। খালেদকে আমি একটু গম্ভীরভাবেই বললাম, ‘আপনি ১১টার সময় এখানে এলেন আর সারা দিন কিছুই হলো না, কিছুই জানালেন না।’ মোশতাক বৈঠক করছেন, ওদিকে অফিসাররা ক্ষিপ্ত। খালেদ অবস্থাটা বুঝতে পারলেন মনে হলো। তিনিসহ আলাপরত তিনজনই উঠে বাইরে চলে গেলেন। আমি যাঁদের নিয়ে গিয়েছিলাম, তাঁদের নিয়ে বসলাম। হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে চিৎকার শুনতে পেলাম। মোশতাকের কণ্ঠ। তিনি বলছেন, ‘আই হ্যাভ সিন মেনি ব্রিগেডিয়ারস অ্যান্ড জেনারেলস অব পাকিস্তান আর্মি। ডোন্ট টাই টু টিচ মি’।
দরজা খুলে বেরিয়ে আমরা দেখি, করিডরে মোশতাক উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। মোশতাকের পাশে দাঁড়িয়ে ওসমানী। ৪ তারিখ সকালে ১ম বেঙ্গলের দুটো কোম্পানিকে বঙ্গভবনের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। একটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর ইকবাল, পরে অব, এবং মন্ত্রী। করিডরে ইকবাল ও শখানেক সৈন্যও ছিল। মেজর ইকবাল মোশতাকের কথার জবাবে ততোধিক উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘ইউ হ্যাভ সিন দি জেনারেলস অব পাকিস্তান আর্মি। নাউ ইউ সি দা মেজরস অব বাংলাদেশ আর্মি।’ এর মধ্যে সৈনিকেরা গুলি চালানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। ওসমানী সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে দূরে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘শাফায়াত সেভ দা সিচুয়েশন, ডোন্ট রিপিট বার্মা।’ আমি গিয়ে ইকবাল ও মোশতাকের মধ্যে দাঁড়ালাম। ইকবালকে বললাম, ‘তুমি সরে যাও।’
আর মোশতাককে বললাম ক্যাবিনেট রুমে ঢুকতে। ক্যাবিনেট রুমে আমিও ঢুকলাম। দেখি এক কোনায় মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান বসা। তাঁকে দেখেই আমি তুললাম জেল হত্যাকাণ্ডের কথা। খলিলুর রহমানকে উদ্দেশ করে বললাম, ‘আপনি চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ, প্রায় ৪০ ঘণ্টা হয়ে গেছে জেলখানায় জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, তারও ঘণ্টা কুড়ি পর দেশত্যাগ করেছে খুনিরা, আপনি সবই জানেন, কিন্তু আমাদের বলেননি কিছুই। এই ডিসগ্রেসফুল আচরণের জন্য আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।’ খলিল কোনো কথা বললেন না। আমি যখন এদিকে ব্যস্ত, ক্যাবিনেট রুমে তখন খালেদ মোশাররফের এডিসি ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির ও কর্নেল মালেক (পরে অব. এবং ঢাকার মেয়র) ভাষণ দিচ্ছিলেন।
যাহোক, এরপর আমি মোশতাককে ধরলাম। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষা করেই বললাম, ‘স্যার, আপনি আর এই পদে থাকতে পারবেন না। কারণ, আপনি একজন খুনি। জাতির পিতাকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। জেল হত্যাকাণ্ড আপনার নির্দেশে হয়েছে। এসব অপরাধের জন্য বাংলার জনগণ আপনার বিচার করবে। আপনি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন।’ আমি আরও বললাম, ‘আপনি পদত্যাগ করার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি হবেন।’ আমি এ কথা বলামাত্রই মন্ত্রী ইউসুফ আলী প্রতিবাদ করে বললেন, ‘কোন বিধানে এটি হবে?’ তিনি বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে ভাইস রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতি।’ আমি জবাব দিলাম, ‘খন্দকার মোশতাক যে বিধানে আজ রাষ্ট্রপতি, একই বিধানে প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি করতে হবে। মোশতাককে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যেমন সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রেও তেমনি করতে হবে।’
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করার জন্যও তাঁকে আমি চাপ দিলাম। জিয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং খালেদকে নিযুক্তি দিতে মোশতাক প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে ওসমানীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান বললেন। যাহোক, আমার অনমনীয়তায় মোশতাক এটাও মেনে নিতে বাধ্য হন।
আমি মিটিং কক্ষে ঢোকার আগেই ক্যাবিনেট জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে লোকদেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। আমি বললাম, ‘ওই কমিটিতে কাজ হবে না। হাইকোর্টের জজের নিচের কেউ এতে থাকতে পারবে না।’ এ কথা বলে আমি বেরিয়ে এলাম।
কর্নেল মালেক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির দায়িত্ব নিলেন। মোশতাকের পদত্যাগপত্র, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে প্রমোশনসহ চিফ অব স্টাফ করা ও জেলহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি হলো। রাষ্ট্রপতি মোশতাক তাতে সই করলেন।
এদিকে খালেদের পিএস লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হক জেলহত্যার ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করলেন। ৬ তারিখে টেপটা আমি পাই। ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আমার অফিসের চেস্ট অব ড্রয়ারে তা রাখি। পরে আর কখনো হেডকোয়ার্টারে যেতে পারিনি আমি। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পান আমিনুল হক।
আমিনুল হকই এ টেপের কথা বলতে পারবেন। মোশতাককে গৃহবন্দী করে রাখা হলো প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে। তাঁর মন্ত্রীদের মধ্যে ১৫ আগস্টের ও জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে পাঠানো হলো সেন্ট্রাল জেলে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পর রাত ১২টার দিকে বঙ্গভবন থেকে বাসায় ফিরে এলাম আমি।
৫ তারিখ সকালে বিডিআরের ডিজি মেজর জেনারেল দস্তগীর আমার ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে আসেন। প্রবীণ ও আস্থাভাজন মেজর জেনারেল দস্তগীরকে আমি অচলাবস্থার কথা উল্লেখ করে জানাই, সেনা হেডকোয়ার্টার কোনো কিছুতেই উদ্যোগ নিচ্ছে না। ত্বরিতগতিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মোশাররফের ওপর প্রভাব খাটাতে আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম। দুদিন ধরে রেডিও-টিভি বন্ধ। দেশময় উৎকণ্ঠা, নানা আশঙ্কা। ইতিমধ্যে আমি এবং আরও অনেকে খালেদ মোশাররফকে বারবার অনুরোধ করি রেডিও-টিভিতে জাতিকে সবকিছু অবহিত করে একটা ভাষণ দেওয়ার জন্য। খালেদের এক কথা, নতুন রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই কেবল ভাষণ দেবেন।
খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচার হয়েছে এ দেশে। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি দেশের ক্ষমতা দখল করতে চাননি এবং করেনওনি। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব নিয়ে রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিতে চাননি। ক্ষমতা দখলের লোভ থাকলে তিনি সেটা অনায়াসেই করতে পারতেন। ক্ষমতালোভী বা উচ্চাভিলাষী কোনোটাই ছিলেন না খালেদ মোশাররফ। তিনি ছিলেন শৃঙ্খলার প্রতি নিবেদিত একজন সেনানায়ক। তাঁর সেনাপ্রধান নিযুক্তি অথবা প্রমোশন তিনি নিজ উদ্যোগে নেননি। আমরা আমাদের প্রয়োজনে তাঁকে তা করেছিলাম।
যাহোক, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকেই রাষ্ট্রপতির ভাষণের একটা কপি তৈরি করলাম আমরা। মেজর জেনারেল দস্তগীরকে সঙ্গে করে সেনা সদরে গেলাম। বেশ কয়েকজন (১৫-২০ জন হবে) সিনিয়র অফিসারকে নিয়ে খালেদ মোশাররফ বিষয়টা পর্যালোচনা করার জন্য বৈঠকে বসলেন। আমাদের তৈরি ভাষণের ড্রাফট নিয়ে প্রায় সারা দিন আলোচনা করলেন তিনি। এ ভাষণই প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় ৬ নভেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশে পাঠ করেন রাষ্ট্রপতি-নিযুক্ত বিচারপতি সায়েম।
রাষ্ট্রপতি সায়েমের ভাষণে আমাদের অগোচরে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেটি হচ্ছে সংসদ ভেঙে দেওয়া। পরে শুনেছি, খন্দকার মোশতাকের আস্থাভাজন শফিউল আজম (যিনি বঙ্গভবনে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবস্থান করছিলেন) অনাকাঙ্ক্ষিত এই কাজ করেন। বিচারপতি সায়েমের ভাষণের মূল ভাষ্য ছিল, ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরবে ইত্যাদি। সবাইকে যার যার দায়িত্ব নির্ভয়ে পালন করতে বলা হলো। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ড করেছে উচ্ছৃঙ্খল কিছু সেনাসদস্য, যার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয়। এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার হবে।
৫ তারিখ সন্ধ্যায়ই আমরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় খালেদ মোশাররফ, এম জি তাওয়াব, এম এইচ খানসহ আমরা বিচারপতি সায়েমের বাসভবনে গেলাম। সায়েম ধৈর্যসহকারে খালেদের বক্তব্য শুনলেন। এর আগে অবশ্য তাঁকে একবার বঙ্গভবনে ডেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথাটি জানানো হয়েছিল। যাহোক, সায়েম এখন খালেদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেন। আমরা একটু পীড়াপীড়ি করায় বললেন, ‘পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।’ বিচারপতি সায়েম তক্ষুনি উঠে ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এলেন তিনি। এত তাড়াতাড়ি যে আমাদের মনে হলো, প্রায় এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকলেন তিনি! এ সময়ের মধ্যে কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন, তা তিনিই জানেন। তো সায়েম এসেই বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
এদিকে ৫ তারিখে সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ রংপুর ব্রিগেড থেকে ২ ব্যাটালিয়ন এবং কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে কারণেই হোক, খালেদ মোশাররফ এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ নেননি বলে বিষয়টি আমি জানতাম না। ৬ তারিখ সকালে রংপুর ব্রিগেডের সৈন্যরা ঢাকায় উপস্থিত হলে আমি বিষয়টি জানতে পারি। রংপুর ব্রিগেডের দশম বেঙ্গল এসে অবস্থান করছিল শেরেবাংলা নগরে। অন্যটির কিছু অংশ সাভারে, বাকি অংশ নগরবাড়ী ঘাটে। এই ব্যাটালিয়ানটির কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমাম।
জাফর ইমাম স্ব-উদ্যোগে ৪ তারিখ রাতেই আমাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে মিলিত হন।
আমার অজ্ঞাতে অতিরিক্ত সৈন্য আনার এমন ঘটনা ঘটায় আশ্চর্য হই, খটকাও লাগে। যাহোক, কুমিল্লা থেকে যে ব্যাটালিয়নটিকে আসতে বলা হয়েছিল, তারা আর শেষ পর্যন্ত আসেনি। অজ্ঞাত কারণে কর্নেল আমজাদ তাদের পাঠানো থেকে বিরত থাকেন। এদিকে ৫ তারিখ সকাল থেকেই যশোর ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী (যিনি খালেদ মোশাররফের পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির (পিএমএ) সতীর্থ এবং শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন) অনবরত ফোন করতে থাকেন ঢাকায় আসার অনুমতি দেওয়ার জন্য। এমনকি মীর শওকতের স্ত্রীও খালেদ মোশাররফের স্ত্রীকে অনুরোধ করেন খালেদকে এতে রাজি করানোর জন্য।
খালেদ মোশাররফ মীর শওকতের বারবার টেলিফোনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। অবশেষে খালেদ তাঁকে ঢাকায় আসার অনুমতি দেন। ৬ তারিখ বিমানযোগে ঢাকা আসেন মীর শওকত। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ ২-৩ ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। আমার ধারণা, বৈঠকে তাঁরা বোধ হয় জিয়ার ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করে থাকবেন। আমার এটাও মনে হয়, পরবর্তীকালে খালেদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে একটি বড় ভূমিকা ছিল ওই রুদ্ধদ্বার বৈঠকের। আমার ধারণা একেবারে কল্পনাপ্রসূত নয়।
৬ তারিখ দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সায়েমের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলো। দুপুর থেকেই বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ইত্যাদি জায়গা থেকে ট্যাংকগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আনা শুরু হলো। সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সব ট্যাংক তাদের ইউনিট লাইনে চলে আসে। গোলন্দাজ রেজিমেন্টের কামানগুলো লাইনে ফেরত এসেছিল ৪ তারিখেই।
৬ তারিখ বিকেলে খবর পেলাম ক্যান্টনমেন্টে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি সংগঠনের উসকানিমূলক লিফলেট ছড়ানো হয়েছে। এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্বের কথা সেদিনই প্রথম জানি আমরা। আগে কখনো এ সম্বন্ধে কোনো তথ্য আমাদের সরবরাহ করা হয়নি। এটা সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা বা তারা তা গোপন রেখেছিল। যাহোক, শুনলাম, ক্যান্টনমেন্টে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে সৈনিকদের মধ্যে। অফিসারদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা চলছে তাদের মধ্যে। সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ সৈনিকদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে সন্ধ্যার দিকে ট্যাংক রেজিমেন্টে গেলেন। আমিও ছিলাম তাঁর সঙ্গে। সৈনিকদের তিনি ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে অঙ্গীকার করলেন।
ট্যাংক রেজিমেন্ট থেকে ফিরে সেনা সদরে বৈঠক করলেন খালেদ। সৈনিকদের সমস্ত অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। বললেন, পরদিন থেকে সৈনিকদের স্বাভাবিক ট্রেনিং শুরু হবে। সব দিক থেকে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিলেন। ওই বৈঠকের পরপরই আমি সেনাপ্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে গিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম।
রাত ১০টার দিকে খালেদ মোশাররফের ফোন পেলাম। ফোনে তিনি আমাকে বঙ্গভবনে যেতে বললেন। বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছি, তখন ব্রিগেডিয়ার মেজর হাফিজ আমাকে বলল, ‘স্যার, একটা জরুরি কথা আছে।’ হাফিজ জানাল, প্রথম বেঙ্গলের একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ওই দিন রাত ১২টায় সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার আহ্বানে তারা এটা করবে। খালেদ ও আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশও সৈনিকদের দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেসিওটি। ওই জেসিও, যিনি একজন সুবেদার ছিলেন, বলেছেন আমাদের এ কথা জানিয়ে সতর্ক করে দিতে।
১১টার দিকে আমি বঙ্গভবনে পৌঁছালাম। দুই বাহিনী (বিমান ও নৌ) প্রধানকে সেখানে দেখলাম। খালেদ তখনো আসেননি। তিনি এলেন ২০-২৫ মিনিট পর। শুনলাম একটি দৈনিকের সম্পাদক তাঁর বাড়িতে যাওয়ায় আটকে পড়েছিলেন খালেদ। পরে জানি, ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দুজন বিশিষ্ট সম্পাদক (একসময় যাঁদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল) প্রায়ই খালেদ মোশাররফের বাড়িতে যেতেন এবং পরামর্শের নামে তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করতেন। ৬ তারিখ রাতেও আমরা যখন বঙ্গভবনে অপেক্ষা করছি, এই দুই সম্পাদকের একজন তখন তাঁর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, ৭ তারিখের পর ওই দুই সম্পাদকের কাগজেই খালেদ ও তাঁর সহকর্মীদের ‘রুশ-ভারতের দালাল’ বলে চিহ্নিত করে অশালীনভাবে বিষোদ্গার করা হতে থাকে।
যাহোক, খালেদ আমাকে ডেকেছিলেন একটা মধ্যস্থতার জন্য। সামরিক আইন প্রশাসকদের বিন্যাস কীভাবে হবে, তা নিয়ে অন্য দুই বাহিনীপ্রধানের সঙ্গে তাঁর মতভেদ দেখা দিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরই মোশতাক সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হন। সেই সঙ্গে স্থগিত করেন সংবিধানের কার্যকারিতা।
তো খালেদ বলছিলেন, সিএমএলএ বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়া উচিত সেনাপ্রধানেরই। কারণ, সশস্ত্র বাহিনী কিছু করলে তার দায়দায়িত্ব সেনাপ্রধানের ওপরই বর্তায়। অন্য দুই প্রধানের দাবিমতো রাষ্ট্রপতি সিএমএলএ এবং তিনজন (সেনা, বিমান ও নৌপ্রধান) ডিসিএমএলএ হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হতে পারে। অন্য দুই প্রধান সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সেনাপ্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে নাজুক অবস্থায় পড়বেন—এ ভাবনাও হয়তো খালেদের মধ্যে ছিল। কথাবার্তার একপর্যায়ে খালেদকে আমি ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতির কথা বললাম। আমাদের যে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা-ও জানালাম। তিনি বিশেষ গ্রাহ্য করলেন না আমার কথা। আমরা কথাবার্তা বলছি, ১২টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোন এল। ফোনে বলা হলো, সিপাহিদের ‘বিপ্লব’ শুরু হয়ে গেছে। তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। এ কথা শোনার পর খালেদ মিটিং ভেঙে দিলেন। খালেদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এসেছিলেন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদা ও চট্টগ্রামের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দার। হায়দার খুব সম্ভব ছুটিতে ছিলেন এবং ঘটনাচক্রেই খালেদের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর।
মিটিং ভেঙে দিয়ে হুদা ও হায়দারকে নিয়ে চলে গেলেন খালেদ মোশাররফ। অন্য দুই চিফও চলে গেলেন। তবে খালেদ আমাকে বললেন বঙ্গভবনেই থাকতে। তিনি নিজে প্রথমে যান মোহাম্মদপুরে কোনো এক আত্মীয়বাড়িতে। সেখান থেকে তাঁরা যান রংপুর ব্রিগেড থেকে আসা দশম বেঙ্গলের অবস্থানস্থল শেরেবাংলা নগরে।
রাত ১২টার পর সিপাহিরা ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে জিয়াকে মুক্ত করে ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে।
শেষ রাতের দিকে ১০ম বেঙ্গলের অবস্থানে যান খালেদ। পরদিন সকালে ওই ব্যাটালিয়নে নাশতাও করেন তিনি। বেলা ১১টার দিকে এল সেই মর্মান্তিক মুহূর্তটি। ফিল্ড রেজিমেন্টে অবস্থানরত কোনো একজন অফিসারের নির্দেশে দশম বেঙ্গলের কয়েকজন অফিসার অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় খালেদ ও তাঁর দুই সঙ্গীকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি আজও।
আগেই বলেছি, ৬ তারিখ রাতে খালেদ মোশাররফ চলে যাওয়ার পরও আমি বঙ্গভবনে থেকে যাই তাঁর নির্দেশে। খালেদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি আমার। তারপর তো ‘সিপাহি বিপ্লব’ হয়ে গেল। রাত তিনটার দিকে জিয়া ফোন করলেন আমাকে। বললেন, ‘ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট। লেটস ইউনাইট দি আর্মি’। আমি এত ক্ষুব্ধ ছিলাম যে জিয়াকে একটু রূঢ়ভাবেই বলি, ‘আপনি সৈনিকদের দিয়ে বিদ্রোহ করিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। আপনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, আর নামতে পারবেন না। যা করার আপনি অফিসারদের নিয়ে করতে পারতেন, সৈনিকদের নিয়ে কেন?’ সেনাবাহিনীর মধ্যে হিংসা ও বিভেদের রাজনীতি ঢোকানো হয়েছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করি আমি।
রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ বঙ্গভবনের অদূরে ‘নারায়ে তাকবির’, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান শুনলাম। সেই সঙ্গে ফাঁকা গুলির আওয়াজ। দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটি পদাতিক কোম্পানি তখন বঙ্গভবনের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল। আরেকটি ছিল রক্ষীবাহিনী থেকে সদ্য রূপান্তরিত পদাতিক ব্যাটালিয়নটির একটি কোম্পানি। এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ক্যাপ্টেন দীপক। কোম্পানি কমান্ডারদের নির্দেশ দিলাম পজিশন নিতে এবং বিদ্রোহী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা গুলি করলে তাদের প্রতিরোধ করতে। ১৫-২০ মিনিট পর গুলি ও স্লোগান আরও তীব্র এবং নিকটতর হয়ে উঠল। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, যাদের প্রতিরোধের জন্য পাঠিয়েছি, তারা পাল্টা গুলি করছে না! তখন আমার বোধোদয় হলো, বিদ্রোহী সিপাহিদের ওই স্লোগানে তারাও ইমমোবিলাইজড হয়ে গেছে। তারা ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করবে না।
এ ঘটনা দেখার পর আমার সঙ্গে থাকা অন্য একজন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন দিদার আমাকে বলল, ‘স্যার, চলুন আমরা বেরিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করি।’ ওদিকে ফায়ারিং ও স্লোগান একেবারে সামনে এসে গেল। উপায়ান্তর না দেখে আমি দিদার ও কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে বঙ্গভবনের পেছনের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময় আমার পা ভেঙে যায়। যাহোক, বাইরে থাকা একটি সামরিক ডজ গাড়িতে উঠলাম সবাই। এই অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া সমীচীন মনে হলো না। আমার তখন জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। ভেবে দেখলাম, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এখনো শান্ত। তাই সেই অভিমুখেই রওনা হলাম।
সেখানে গিয়ে সিএমএইচে চিকিৎসা নেওয়া যাবে। মেঘনা ফেরিঘাটে পৌঁছে মনে হলো, কুমিল্লা যাওয়াও ঠিক হবে না। এতক্ষণে সেখানকার পরিস্থিতি হয়তো পাল্টে গেছে। সঙ্গী সৈনিকদের ফেরত পাঠিয়ে আমি ও দিদার নৌকা করে মুন্সিগঞ্জ রওনা হলাম। উল্লেখ্য, মেঘনা ফেরিঘাটে কর্মরত বিআইডব্লিউটিসির কর্মচারীদের কাছ থেকে আমরা সাধারণ শার্ট আর লুঙ্গি নিয়ে ইউনিফর্ম ছেড়ে সেগুলো পরে নিই।
নৌকায় ঘণ্টা দুয়েক চলার পর দেখলাম, মুন্সিগঞ্জের এসডিও একটা লঞ্চ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছেন। আমি তাঁর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার কথা বললাম। ক্যাপ্টেন দিদারের পরিচয় গোপন করে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমাকে সাহায্য করা এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হিসেবে। এসডিও আমাকে সঙ্গে করে নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে গেলেন। সেখানে পুলিশি হেফাজতে রাখা হলো আমাকে। আর দিদার জনতার সঙ্গে মিশে গেল।
নারায়ণগঞ্জ থানা থেকে ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জিয়ার পক্ষে মীর শওকত আমাকে বললেন, ‘তুমি ওখানেই থাকো। আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিনুল হককে পাঠাচ্ছি। সে তোমাকে নিয়ে আসবে।’
ঘণ্টা দুয়েক পর আমিনুল হক এল। তার সঙ্গে ২-৩টি গাড়িতে চতুর্থ বেঙ্গলের কিছু সৈন্য। ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। ঢাকা পৌঁছে আমাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হলো। সিএমএইচে গিয়েই শুনি খালেদ, হায়দার ও হুদার নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর। পরে শুনি, মুক্তি পেয়ে ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে আসার পর জিয়া নিজে বলেছিলেন, ‘দেয়ার শুড বি নো ব্যাডশেড। নো রিটরিবিউশেন। নোবডি উইল বি পানিশড উইদআউট প্রোপার ট্রায়াল।’
মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর ৭ ডিসেম্বর রিলিজ করা হলো আমাকে। তারপর পাঠানো হলো ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রটেকটিভ কাস্টডিতে। ’৭৬ সালের ৭ মার্চ ছাড়া পেলাম আমি। তৎকালীন ডিএমআই লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহসীন (পরে ব্রিগেডিয়ার এবং ফাঁসিতে নিহত) আমাকে সেন্ট্রাল জেল থেকে বাসায় পৌঁছে দিলেন। সেই সঙ্গে আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হলো বরখাস্তের আদেশ। আমার চাকরিচ্যুতির ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন আমাদেরই মনোনীত ও নিয়োজিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম।
–সংক্ষেপিত
কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম: ১৯৭৫ সালে ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক
সূত্র: পঁচাত্তরের অস্থির সময়: ৩ নভেম্বর ৭ নভেম্বরের অকথিত ইতিহাস, সম্পাদক: মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন।