
গোপালগঞ্জে ‘রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষ, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনায় পাঁচজন নাগরিক নিহত এবং বহু মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায়’ গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)।
আজ শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে এইচআরএফবি। সংগঠনটি বলেছে, এ ধরনের ঘটনা নাগরিক নিরাপত্তা, সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এ ঘটনায় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
বিবৃতিতে গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বলা হয়, ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজনৈতিক সমাবেশ শেষে একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় একটি অংশ হামলা চালায়। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনতার ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এতে দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), সোহেল মোল্লা (৪১), ইমন (২৪) এবং পরবর্তী সময়ে গতকাল শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রমজান মুন্সী (২৮) নামের আরও এক নাগরিকের মৃত্যু হয়। আহত অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের কারও কারও অবস্থা সংকটাপন্ন।
এইচআরএফবি মনে করে, জনসমক্ষে গুলি চালিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত শুধু অমানবিক নয়, তা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সরাসরি লঙ্ঘন। এই ধরনের অতিমাত্রায় বলপ্রয়োগ কোনো অজুহাতেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটি স্পষ্টতই রাষ্ট্রের জবাবদিহির অভাবের বহিঃপ্রকাশ বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর সদস্যরা জনতার দিকে গুলি ছুড়ছে। এ দিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, গোপালগঞ্জে পুলিশ কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করেনি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ হস্তক্ষেপ করেছে, এবং আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা আইএসপিআর দেয়নি।
বিবৃতিতে সংগঠনটি বলছে, সংঘর্ষ-পরবর্তী সময়ে যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁদের যথাসময়ে আদালতে উপস্থাপন করতে হবে এবং অবশ্যই তাঁদের সঙ্গে ন্যায় ও আইনসংগত আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন কোনো নিরপরাধ নাগরিক হয়রানির শিকার না হয়। একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী কারফিউ বা অনির্দিষ্টকাল গণপরিবহন ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধরনের প্রতিটি মৃত্যু ও নির্যাতন অনাকাঙ্ক্ষিত এবং প্রচলিত আইনে এসব নির্যাতন ও মৃত্যুর বিচার হওয়ার দাবি রাখে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তত একটি পরিবার গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, পরিবারের পক্ষ থেকে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করতে চাওয়ার পরেও হাসপাতাল ও পুলিশ প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা না পেয়ে লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে হয়েছে। এই পরিবারের অভিযোগ গুরুতর, একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে গাফিলতিসহ প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা লঙ্ঘনের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিহত পাঁচ নাগরিকের মৃত্যুসহ ঘটে যাওয়া সার্বিক পরিস্থিতিতে অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সমাবেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত, দায়ীদের বিচার নিশ্চিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন এইচআরএফবি এক্সপার্ট হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, আইন ও সালিস কেন্দ্রের চেয়ারপারসন এবং এইচআরএফবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না। স্বাক্ষরকারী এইচআরএফবির সদস্যদের মধ্যে আছেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ফওজিয়া মোসলেম।