জুলাই আন্দোলনে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। গ্রাফিতিগুলো এখনো রাজধানীর দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এই গ্রাফিতি জুলাই অভ্যুত্থানের গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
জুলাই আন্দোলনে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। গ্রাফিতিগুলো এখনো রাজধানীর দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এই গ্রাফিতি জুলাই অভ্যুত্থানের গৌরবোজ্জ্বল সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়

বিশেষ লেখা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান যে বার্তা দিয়ে গেল

বিপুল জনস্মৃতি ও প্রত্যাশা এবং নানা অনিশ্চয়তার দোলাচলের মধ্যে প্রথম বছর পূর্ণ হলো জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের। এই অভ্যুত্থানে সারা দেশের নাগরিক শক্তির এক অসাধারণ ও দুঃসাহসী ঐক্য গড়ে ওঠে, যা চেপে বসা শেখ হাসিনার দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে উৎখাত করে।

সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অভ্যুত্থানের সূচনা। নেতৃত্ব দেন তরুণ ছাত্রছাত্রীরা। উত্তরোত্তর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার সে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর সরকার নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চাপিয়ে দিলে এই দমন–প্রচেষ্টা সীমাহীন নিষ্ঠুরতায় পৌঁছায়। সাধারণ মানুষ দেশের সন্তানদের এই অবাধ হত্যাকাণ্ড কিছুতেই মেনে নেয়নি। মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে তারা দলে দলে রাজপথে নেমে এসে শেখ হাসিনাকে দেশছাড়া করে।

আন্দোলনের ভেতরে–বাইরে

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসন গণ–অভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করেছিল। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পরপর তিনটি নিয়ন্ত্রিত ও একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্রমশ নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম করে সব রকমের বিরোধী মত ও কার্যক্রম কার্যত রুদ্ধ করে দেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, গায়েবি মামলা ইত্যাদি আইনি–বেআইনি নিষ্পেষণে দেশ ত্রাসের রাজত্বে পরিণত হয়। বিরোধী মতের প্রকাশ হয়ে ওঠে অপরাধ, গণমাধ্যম নজিরবিহীন আক্রমণের শিকার হয়, রাজনৈতিক নিগড়ে বাঁধা পড়ে বিচারব্যবস্থা।

দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সময়ে–সময়ে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিলেও বলপ্রয়োগে ও কূটকৌশলে সরকার তা অকার্যকর করে দেয়। দলটির কর্মীদের ওপর দুর্বিষহ অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে সরকার আন্দোলনগুলো দমন করে। বস্তুত আওয়ামী শাসনের দেড় দশকে তাঁরা অপরিসীম নির্যাতনের শিকার হন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও একইভাবে দমন করা হয়।

কোটাবিরোধী আন্দোলনের উন্মেষ এই রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে। এ আন্দোলনের পূর্বসূত্র পাওয়া যাবে স্কুলছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে। বিপুল জনসমর্থিত এসব আন্দোলন দানা বেঁধেছিল ‘অরাজনৈতিক প্রজন্ম’ বলে চিহ্নিত কিশোর–তরুণ ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে। এ আন্দোলনগুলোই হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটায়, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান যার চূড়ান্ত প্রকাশ। এসব আন্দোলনে বিকাশপ্রবণ নতুন রাজনীতির নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, পুরোনো আদলের রাজনীতি যাকে আমলে নেয়নি।

সাজ্জাদ শরিফ

গত বছরের জুলাই–আগস্টে সরকারের নানা বাধা ও নিপীড়নের মধ্যে ছাত্রনেতারা অভিনব সব কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখে এবং জনতাকে সম্পৃক্ত করে একে গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত করে। ১ জুলাই আন্দোলনটির নাম হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। ‘বৈষম্যবিরোধী’ শব্দটি সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ নাগরিকমণ্ডলীর চেতনাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আবু সাঈদ শহীদ হলে রাস্তায় মানুষের ঢল নামতে শুরু করে।

এরপর সরকারের চালিয়ে যাওয়া অকাতর নিধনযজ্ঞ সত্ত্বেও জোয়ারের মতো গণপ্রতিরোধ আর দমানো যায়নি। শেখ হাসিনা নাগরিকদের বিরুদ্ধে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন। শেষ সময়ে তিনি সামরিক বাহিনীকেও নিধনযজ্ঞে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশে তাদের অসম্মতি ছিল আন্দোলনে মোড় ফেরানো বিশেষ মুহূর্ত। অবশেষে হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।

গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা

কোনো রাজনৈতিক রূপরেখা বা রাষ্ট্রকল্প সামনে রেখে জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান ঘটেনি। ছাত্রদের সঙ্গে লাখো জনতা যোগ দিয়ে আন্দোলনটিকে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে রূপ দেয়। আন্দোলন সুস্পষ্ট রাজনৈতিক আকার পায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানিয়ে এক দফা ঘোষণার পরে। এ সময়ে মত–পথনির্বিশেষে নাগরিকদের উত্থান ঘটে একক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা রদবদলের পথ সরকার রুদ্ধ করে দিয়েছিল। সম্মিলিত শক্তিতে, নিজেদের সার্বভৌম সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটানো ছাড়া দেশবাসীর তখন অন্য কোনো উপায় ছিল না।

আন্দোলনের মধ্যে কোনো রাষ্ট্রকল্প না থাকলেও গণ–অভ্যুত্থান নিজে আকাশচুম্বী জন–আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। এই জন–আকাঙ্ক্ষায় জোয়ার আসে চিহ্নিত করার মতো অন্তত তিনটি ধারায়।

প্রথমত, এ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন স্কুলছাত্র, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসাপড়ুয়া, শিক্ষক, নারী, শ্রমিক, পেশাজীবী ইত্যাদি নানা স্তর ও বর্গের মানুষ। বাম, ডান, মধ্যপন্থী—নানা পক্ষের রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকেরা আন্দোলনে যোগ দেন। নারী, শ্রমিক এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা—সমাজে যাঁরা নানাভাবে প্রান্তিক হয়ে থাকেন, তাঁদের অংশগ্রহণ ছিল অবারিত। নারীরা নানা পর্যায়ে আন্দোলনকে উজ্জীবিত রাখেন। রাজধানীর প্রান্তবর্তী কোনো কোনো অঞ্চলে অকাতরে প্রাণ দিয়ে রাজপথের দখল রাখেন শ্রমিকেরা। রাষ্ট্রীয় পরিসরে তাঁরা যে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, আওয়ামী শাসনের সঙ্গে এসবেরও অবসান ঘটবে—এমন একটি সাধারণ প্রত্যাশা তাঁদের ছিল। অভ্যুত্থানের শেষ দিকে এবং পরের কিছু দিনে সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিতে সাধারণ মানুষের বিচিত্র আকাঙ্ক্ষার তীব্র প্রকাশ লক্ষ্য করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, যে ছাত্রনেতারা এ আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছিলেন বিভিন্ন পাঠচক্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংস্কৃতিচর্চা থেকে। তাঁদের মন গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ের দেশ–বিদেশের নতুন চিন্তাধারায়। দর্শন, ইতিহাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে পাঠ ও তর্ক তাঁদের নতুন রাজনৈতিক কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করেছে। তাঁদের লেখা, সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা বা বিবৃতিতে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই গণ–অভ্যুত্থান তাঁদের রাষ্ট্রকল্পনা বাস্তবায়নের অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দেয়।

তৃতীয়ত, অভ্যুত্থানের পরপর প্রথম কয়েক মাসে দেশে আলোচনা সভার হিড়িক পড়ে। সেসব সভা–সেমিনারে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তরুণ, প্রবীণ, আন্দোলনকারী, বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী ও জন–বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপকভাবে অংশ নেন। তাঁদের আলোচনা ও তর্কবিতর্ক গণমাধ্যম হয়ে নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এবং আলী রীয়াজের সহসভাপতিত্বে সরকারের গঠন করা ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আলোচনার অতিগুরুত্বপূর্ণ পর্বটি এখনো চলমান। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে সেখানে মতবিনিময় করছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো।

বিভিন্ন মাধ্যমে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিয়ে গণ–আকাঙ্ক্ষা কোনো একটি মাত্রায় প্রকাশিত না হলেও সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন, যা ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাধারণভাবে বললে এর বিষয়সূচিতে ছিল নতুন সংবিধান রচনা বা সংবিধানের জনগণতান্ত্রিক সংশোধন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, নাগরিকদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কার, ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি, লিঙ্গীয় বিভেদের অবসান ইত্যাদি।

উত্থান–পতনময় বছর

গণ–অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের জন্ম হয়েছিল এবং অনেকেই যে রাষ্ট্রের আমূল প্রগতিশীল রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন, পরবর্তী ঘটনাধারায় তা ম্লান হতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে দলীয় নকশায় গড়ে তোলা প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সরকারি প্রণোদনায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো পুলিশ বাহিনীও তার নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলে। এই ভেঙে পড়া প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

এই শূন্যতায় অপরাধ, নৈরাজ্য ও হিংসা ব্যাপক সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রক্ষণশীল ভাবাদর্শের আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা এবং নীতি–পুলিশগিরি। আক্রান্ত হয় মাজার–খানকা–মণ্ডপ, বাধাগ্রস্ত হয় যাত্রা–নাটক–চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ভাবাদর্শগত চাপ, হুমকি এবং প্রকাশ্য লাঞ্ছনায় আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার নারী, শ্রমিক এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে।

গুচ্ছ গুচ্ছ নাম দিয়ে হত্যা মামলা দায়েরের ঢল নামে। উসকানি ও হানাহানি, যৌক্তিক–অযৌক্তিক দাবিতে রাস্তা দখল ও জোটবদ্ধ হামলা, অকারণ আটক বা গ্রেপ্তার, শেখ হাসিনার উপর্যুপরি প্ররোচনাময় ফোনালাপের সূত্র ধরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংস, মিয়ানমারে মানবিক করিডর কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে চট্টগ্রাম বন্দরের তদারকির ভার দেওয়ার বিতর্ক ইত্যাদি একের পর এক উত্তেজনাকর ঘটনা বছরটিকে অস্থির করে রাখে।

এই আবহে জোটবদ্ধ হিংসা বা মব ভায়োলেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শক্তি প্রতিষ্ঠালাভের চেষ্টা করে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করা, আয়নাঘর উন্মুক্ত করে দেওয়া, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া ইত্যাদি প্রশংসনীয় কিছু উদ্যোগ নিলেও অনেক ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তী সরকার বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেনি। বেশ কিছু ঘটনায় সক্রিয় পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার বিবৃতি দিয়ে দায় সারে। জনসমাজে তা বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছে।

সরকার পুরোনো ধারায় আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বহু আলোচিত ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততা, দ্বিধা বা দিকনির্দেশনাহীনতা নাগরিকদের সমালোচনার মুখে পড়ে।

সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ টানাপোড়েনের সূত্রপাত হয় নির্বাচন ও সংস্কারকে ঘিরে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের জন্য শিথিল একটি সময় ঘোষণা করেছিল—কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বর ২০২৫–এ, পর্যাপ্ত সংস্কার চাইলে জুন ২০২৬–এ। এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করা ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি নির্বাচনের আগে পর্যাপ্ত রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি জানায়। দৃঢ়ভাবে এর বিপরীতে অবস্থান নেয় জাতীয়তাবাদী দল। তারা দাবি তোলে ন্যূনতম সংস্কার শেষে এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের। বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে, বিশেষ করে ২১ মে সেনাপ্রধান ওয়াকার–উজ–জামানও ডিসেম্বর ২০২৫–এর মধ্যেই নির্বাচন হওয়া উচিত বলে তাঁর অভিমত জানান। পরস্পরবিরোধী এসব মতামত রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। ২৩ মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন। এ অচলাবস্থার চূড়ান্ত অবসান ঘটে ১৩ জুন, লন্ডনে জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের একান্ত বৈঠকের পরে। জাতীয় নির্বাচনের নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে।

বাস্তবতা হলো, গণ–অভ্যুত্থানের ওপর নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যে বিরোধ দেখা দেয়, তা নাগরিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছিল। দ্রুতই তারা বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদী দল, জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং বিভিন্ন বাম দল যার যার অবস্থান ধরে রাখে। সফল একটি গণ–অভ্যুত্থানের পর এটিই হয়ে আছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। নাগরিক ঐক্যের এই দ্রুত বিভাজন গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনে। গত ২৯ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সংস্কার নিয়ে শিগগিরই কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের অনেকে প্রান্তিক হয়ে পড়েন, কেউ কেউ সরে যান, কেউবা নতুন মেরুকরণে পুরোনো কায়দায় নিজের জন্য জায়গা খুঁজে নেন।

শেষ কথা কে বলবে

তবু বাংলাদেশের পক্ষে আর ৫ আগস্টের আগে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে তার পুরোনো ইতিহাসের শক্তি মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। শাসক যত শক্তিমানই হোক না কেন, দেশের মানুষ অবিভাজ্য রাজনৈতিক সত্তা হয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালে, নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করলে ইতিহাস বদলে দিতে পারে—যেমন ঘটেছিল ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৯০ সালে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান দেশের মানুষকে জানিয়ে দিয়ে গেছে, এই রাষ্ট্রের তারাই মালিক, তারাই জিম্মাদার।

বার্তা শুধু মানুষের জন্যই ছিল না, ছিল শাসকদের জন্যও: স্বৈরাচারী শাসকের কর্তৃত্ব যতই কঠিন হোক, নিষ্ঠুরতা যতই সীমাহীন হোক, গণজোয়ারের মুখে তারা খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য।

সবচেয়ে বড় কথা, জুলাই গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশে এক উজ্জ্বল তরুণ প্রজন্মের অভিষেক ঘটিয়েছে। তাদের অভিষেক ঘটেছে রক্তমাখা মৃত্যু–উপত্যকা পার হয়ে; রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয়েছে লড়াইয়ের ময়দানে, নতুন রাষ্ট্রকল্পনার পরিসরে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তো তাদেরই হাতে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ফিরে ফিরে আসবে—শুধু পতনের গল্প নয়, অপার সম্ভাবনার কথাও মনে করিয়ে দিতে।

সাজ্জাদ শরিফ নির্বাহী সম্পাদক, প্রথম আলো