
গ্লোবাল টিভি বাংলাদেশের হেড অব নিউজ নাজনীন মুন্নীকে চাকরি থেকে বাদ দিতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষকে হুমকি দিয়েছেন কয়েকজন তরুণ। তাঁরা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য পরিচয় দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশীদও তাঁদের সংগঠনের এক সদস্যের ওই কার্যালয়ে গিয়ে এ বিষয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
ওই তরুণেরা ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত চ্যানেলটির কার্যালয়ে গিয়ে হুমকি দেন, নাজনীন মুন্নীকে চাকরিচ্যুত না করলে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো ওই অফিসেও তাঁরা আগুন লাগিয়ে দেবেন। ১৮ ডিসেম্বর রাতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয় ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
নাজনীন মুন্নী এখন গ্লোবাল টিভি বাংলাদেশের হেড অব নিউজ হিসেবে কর্মরত। এই চ্যানেলে তিনি যোগ দেন গত জুলাই মাসে। এর আগে তিনি ডিবিসি নিউজ চ্যানেলে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর ছিলেন। এক দল তরুণের হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে আজ ফেসবুকে একটি পোস্টে নাজনীন মুন্নী লিখেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর শাখা কমিটির নাম করে ৭-৮ জন আমার অফিসে এসে হুমকি দিয়ে গেছে—চাকরি না ছাড়লে অফিসে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো আগুন ধরিয়ে দেবে।’
এ বিষয়ে সাংবাদিক নাজনীন মুন্নীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গণমাধ্যমে ধারাবাহিক আক্রমণের অংশ হিসেবেই তাঁকে চাকরি থেকে বাদ দিতে এই হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে হওয়া অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে এই প্ল্যাটফর্ম ও জাতীয় নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর কয়েক মাস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দৃশ্যমান কার্যক্রম সেভাবে ছিল না। তবে প্ল্যাটফর্মটির নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন নেতিবাচক ঘটনার খবর আসছিল। এমন প্রেক্ষাপটে গত ২৫ জুন ভোটের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি গঠিত হয়।
হুমকি প্রসঙ্গে জানতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রশিদুল ইসলামের (রিফাত রশীদ) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহানগর কমিটির পৃথু নামের এক সদস্য কেন্দ্রের কোনো নির্দেশনা ছাড়া কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে গ্লোবাল টিভিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি স্মারকলিপি দেন, যেটিতে সাংবাদিক নাজনীন মুন্নীকে ফ্যাসিবাদের দোসর উল্লেখ করে অপসারণের দাবি করা হয়। স্মারকলিপিটি আমরা সংগ্রহ করেছি। সেখানে আগুন লাগানোর কোনো কথা লেখা নেই।’ সংগঠনের ওই সদস্যকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের ওপর কোনো আঘাতের পক্ষে নেই। নাজনীন মুন্নী বা গ্লোবাল টিভি আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করলে আমরা তাঁকে বহিষ্কার করব।’
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাজনীন মুন্নী প্রথম আলোকে বলেন, হুমকির ঘটনাটি ২১ ডিসেম্বর রোববারের হলেও তিনি পরদিন অফিসে এসে জানতে পারেন।
ঘটনা সম্পর্কে নাজনীন মুন্নী বলেন, ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তিনি রিপোর্টারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। রাত আটটার দিকে এক বন্ধু দেখা করতে এলে তাঁকে নিয়ে তিনি গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় যান। এরপর রাত সাড়ে আটটার দিকে সাত-আটজন তরুণের একটি দল তাঁর অফিসে আসে। এর আগে তাঁরা চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহমেদ হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে আসেন। নিজেদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মহানগর শাখা কমিটির বলে পরিচয় দেন। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে আসবেন, সেটা এমডিকে ফোনে জানাননি।
নাজনীন মুন্নী বলেন, ‘এমডির সঙ্গে দেখা করে ওই তরুণেরা প্রথমে বলেন, গুলিতে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর কাভারেজ ভালো হয়নি। এরপর তাঁরা আমার (নাজনীন মুন্নী) প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তরুণেরা এমডিকে বলেন, নাজনীন মুন্নীকে কেন রেখেছেন? উনি আওয়ামী লীগের লোক। ওনাকে চাকরিতে রাখা যাবে না। ওনাকে বাদ দিন।’
নাজনীন মুন্নী জানান, তরুণদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমডি আহমেদ হোসেন বলেছিলেন, তাঁরা নাজনীন মুন্নীকে দেখেশুনেই চাকরিতে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
‘আপনারা একেকবার একেকটা বলবেন, সেটা তো হবে না। ওই সময় তরুণেরা বলেন, আমরা বলেছি, এ জন্য বাদ দেবেন। আমাদের কথা শুনতে হবে। নাজনীন মুন্নীকে বাদ না দিলে আপনাদের অফিসেও প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো আগুন লাগিয়ে দেব,’ এমডি আহমেদ হোসেনকে উদ্ধৃত করে বলেন নাজনীন মুন্নী।
নাজনীন মুন্নী জানান, এরপর ওই তরুণেরা একটা কাগজ এমডির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তাতে সই করতে বলেন। ওই কাগজে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নাজনীন মুন্নীকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিশ্রুতির কথা লেখা ছিল। এমডি তাতে সই করতে রাজি হননি। ওই সময় ক্ষুব্ধ হয়ে তরুণেরা বলেন, ‘আমরা যেটা চাই, সেটাই হবে। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারই কিছু করতে পারেনি। আর আপনারা তো কিছুই না।’
এমডি কাগজে সই করেননি, তাঁর বদলে তাঁর সঙ্গে থাকা সহকর্মী সই করেন বলে জানান নাজনীন মুন্নী। তিনি বলেন, ‘এই হুমকি প্রসঙ্গে অফিস আমাকে চুপচাপ থাকতে বলেছিল। কয়েক দিন অফিসে আসতে মানা করেছিল। কিন্তু আমি স্ট্যাটাস দিয়ে দিয়েছি। অফিস কর্তৃপক্ষ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে আমি চুপ থাকব না। দুই দিন পরপর থ্রেট (হুমকি) দিয়ে যায়, এটা মানার মতো না। যমুনা টিভির নিকোলকে (অ্যাসাইনমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং এডিটর রোকসানা আনজুমান নিকোল) হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এর আগে রাজনৈতিক চাপে এ বছরের জুন মাসে আমাকে ডিবিসি চ্যানেল ছাড়তে হয়েছে। আমি বারবার বলেছি, আপনারা প্রমাণ করুন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না। কোনো একটি সম্পৃক্ততাও তারা পায়নি।’
সংবাদমাধ্যমের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের ধারাবাহিকতা থেকে তাঁকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নাজনীন মুন্নী। তিনি বলেন, ‘একটি গোষ্ঠী চাইছে ধারাবাহিক আক্রমণের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে ভয়-ভীতি দেখাতে। আমরা যাঁরা মানুষকে প্রভাবিত করতে পারি, তাঁদের গণমাধ্যমে রাখতে চায় না ওই গোষ্ঠী।’
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য গ্লোবাল টিভি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহমেদ হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। নাজনীন মুন্নীকে চাকরি থেকে বাদ না দিলে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো তাঁর কার্যালয়ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি ‘কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই’ বলে জানান।