ত্বকের সুস্থতায় সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণের আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী
ত্বকের সুস্থতায় সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণের আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী

অনলাইন আলোচনা

সোরিয়াসিস ছোঁয়াচে নয়, রোগীর সংস্পর্শে এলে কোনো ঝুঁকি নেই

সোরিয়াসিস একটি দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ, যেখানে ত্বকে প্রদাহের কারণে খুব দ্রুত নতুন স্কিন সেল তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবে ত্বক ২৮ থেকে ৩০ দিনে নবায়ন হয়, কিন্তু সোরিয়াসিসে সেটা অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত হওয়ায় ত্বকের ওপর সাদা, খসখসে আবরণ তৈরি হয়।

এসকেএফ ডার্মাটোলজি নিবেদিত ‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাব বাংলাদেশের জেনারেল সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুরাইয়া আহমেদ।

সোরিয়াসিস ত্বকের একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এ রোগ নিয়ে এখনো বেশ সতর্কতার অভাব রয়েছে। তাই আলোচনার এ পর্বে সোরিয়াসিস নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী। গত সোমবার প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে পর্বটি সরাসরি সম্প্রচার হয়।

আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, সোরিয়াসিসে কারা বেশি আক্রান্ত হয়? উত্তরে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, ‘রোগটি যেকোনো বয়সে দেখা দিতে পারে। শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক বা বয়স্ক—সবাই আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত ১০-১১ থেকে ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে বেশি দেখা যায়। সোরিয়াসিসের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে বংশগত বা জিনগত (ক্রোমোজোনাল) সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। একই পরিবারে একাধিক সদস্য এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশন বা অন্যান্য ট্রিগারও ভূমিকা রাখে।’

সোরিয়াসিস নিয়ে একটি মিথ আছে, এটি ছোঁয়াচে। তাঁদের উদ্দেশে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, ‘সোরিয়াসিস মোটেও ছোঁয়াচে রোগ নয়, এটি সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ভুল ধারণা। আমরা ডার্মাটোলজিস্টরা রোগীকে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সরাসরি আক্রান্ত স্থানে হাত দিই, যাতে রোগী ও তাঁর স্বজনেরা বুঝতে পারেন যে এটি সংক্রামক নয়। এই ভুল ধারণার শিকড় অনেক পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব যুগে সোরিয়াসিসকে কুষ্ঠরোগের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল। কুষ্ঠরোগ ছোঁয়াচে হওয়ায় তখন সোরিয়াসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও আলাদা করে রাখা হতো। আসলে দুটি রোগ সম্পূর্ণ আলাদা। তাই সবাইকে জানাতে চাই, সোরিয়াসিস কোনোভাবেই ছোঁয়াচে নয়, রোগীর সংস্পর্শে এলে কারও কোনো ঝুঁকি নেই।’

শরীরের কোন কোন স্থানে সোরিয়াসিসের ফ্লেয়ার বা ইনফ্লামেশন বেশি দেখা যায়? এ প্রসঙ্গে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, সোরিয়াসিস শরীরের যেকোনো স্থানে হতে পারে। তবে যেসব জায়গায় বারবার ঘর্ষণ বা প্রেসার পড়ে, সেগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। যেমন কনুই, হাঁটু, কবজি, গোড়ালি (অ্যাঙ্কেল জয়েন্ট) এবং শরীরের অন্যান্য ভাঁজের জায়গা। মাথার স্ক্যাল্পেও সোরিয়াসিস হতে পারে। রিপিটেড ফ্রিকশনের কারণে এসব জায়গা ‘সাইট অব প্রিডিলিকশন’ হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ এসব স্থানে সোরিয়াসিসের প্রবণতা তুলনামূলক বেশি।

সোরিয়াসিস রোগের সঙ্গে অন্য রোগের সম্পর্ক কী? ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন বা আর্থ্রাইটিসের মতো ক্রনিক রোগের সঙ্গে কি এর কোনো সংযোগ আছে?

এসব বিষয়ে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, ‘সোরিয়াসিসকে আমরা আগে শুধু স্কিন ডিজিজ ভাবতাম, কিন্তু এখন একে সিস্টেমিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, এটি শুধু ত্বকে নয়, শরীরের যেকোনো স্থানে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। সবচেয়ে বেশি যেটার সঙ্গে সম্পর্ক দেখা যায়, তা হলো “সোরিয়াসিক আর্থ্রাইটিস”। অনেক সময় রোগী প্রথমে জয়েন্ট পেইন নিয়ে রিউমাটোলজিস্টের কাছে যান। পরে দেখা যায়, ত্বকে ছোট কোনো সোরিয়াসিস লেশন আছে। এ ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, সোরিয়াসিসের সঙ্গে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ডিজঅর্ডার, হার্ট ডিজিজ এবং অন্যান্য মেটাবলিক সমস্যারও সম্পর্ক আছে। এর মূল কারণ হলো, শরীরের অভ্যন্তরে ইমিউনোলজিক্যাল ও ইনফ্লামেটরি চেঞ্জ, যা পুরো সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। তাই ত্বকে খুব ক্ষুদ্র একটি দাগ বা স্কেল হলেও দেরি না করে একজন রেজিস্টার্ড ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যেতে হবে।’

‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় সোমবার (২৪ নভেম্বর)

ডায়াবেটিস রোগীর যদি ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে না থাকে, সোরিয়াসিসের চিকিৎসা কি কার্যকর হবে, নাকি আগে ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে আনতে হবে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, ‘হ্যাঁ, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোরিয়াসিসসহ যেকোনো রোগের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকা অত্যন্ত জরুরি। ডায়াবেটিসকে বলা হয় ‘মাদার অব অল ডিজিজ’। কারণ, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে সোরিয়াসিসসহ টপিক্যাল বা সিস্টেমিক কোনো স্কিন চিকিৎসাই কার্যকর হয় না। শরীরের ভেতরের ইনফ্লেমেশন ও ইমিউন রেসপন্স ডায়াবেটিসের কারণে বিঘ্নিত হয়। ফলে ওষুধ কাজ করার সুযোগ পায় না। এ জন্য রোগীকে বুঝিয়ে বলতে হয়, প্রথম কাজ হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা, তারপর সোরিয়াসিসের চিকিৎসা কার্যকর হবে।’

কোন কোন খাবার খেলে সোরিয়াসিস ট্রিগার হতে পারে বা রোগীর কী কী খাবারে বাধা–নিষেধ আছে? এ প্রসঙ্গে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, কঠোর কোনো নিষেধ তালিকা নেই। তবে কিছু খাবার সোরিয়াসিসকে অ্যাগ্রিভেট করে। বিশেষ করে রেড মিট, যেমন গরু, খাসি বা ভেড়ার মাংস সেল সাইকেলকে স্টিমুলেট করে স্কেলিং বাড়াতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার, বেকারি আইটেম, অতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং ধূমপান বা অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে রোগটি খারাপ পর্যায়ে যেতে পারে। বিপরীতে ওমেগা-থ্রিসমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ, যেমন সালমন, সার্ডিন বা টুনা ইনফ্লেমেশন কমাতে সাহায্য করে।

এরপর উপস্থাপক জানতে চান, শীতকালে কি সোরিয়াসিস বাড়ে এবং গরমকালে কমে? আবহাওয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? উত্তরে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘সোরিয়াসিসে সিজনাল ভেরিয়েশন দেখা যায়। শীতকালে স্কিন আরও ড্রাই হয়, যা ইচিং ও লেশন বাড়ায়। তাই শুধু শীতকাল নয়, সারা বছর ত্বক ময়েশ্চারাইজড রাখা জরুরি। বাজারের ময়েশ্চারাইজারের পাশাপাশি নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। মূল বিষয় হলো ত্বক কখনো যেন ড্রাই না হয়। কারণ, ড্রাই হলে চুলকানি ও লেশন আরও বেড়ে যায়।’

সোরিয়াসিসের সঠিক চিকিৎসা এবং বাংলাদেশে এর বিদ্যমান আধুনিক চিকিৎসা প্রসঙ্গে আবু হেনা চৌধুরী বলেন, সোরিয়াসিস দীর্ঘমেয়াদি রোগ। তাই প্রথমে রোগীকে সচেতন করা জরুরি। মাইল্ড, মডারেট বা সিভিয়ার গ্রেড অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। মাইল্ড ক্ষেত্রে টপিক্যাল স্টেরয়েড ও নন-স্টেরয়েডাল ক্রিম ব্যবহৃত হয়। মডারেট বা সিভিয়ার ক্ষেত্রে ডিজিজ-মোডিফাইং ড্রাগ বা টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োজনে বায়োলজিক থেরাপিও ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে এখন ইউরোপ-আমেরিকার মতো আধুনিক বায়োলজিক চিকিৎসা পাওয়া যায়, যা দ্রুত ও কার্যকরভাবে রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সাহায্য করে।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে দর্শকদের উদ্দেশে ‘সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাব’ সম্পর্কে ডা. এম আবু হেনা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ২০১৭ সালে সোরিয়াসিস অ্যাওয়ারনেস ক্লাব গঠন করি। উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র বাংলাদেশে সচেতনতা তৈরি করা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং রোগীদের জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা। ঢাকায় ওয়ান-স্টপ সেন্টার চালু করেছি, যেখানে বিশেষজ্ঞ সেবা ও স্বল্পমূল্যে ফটোথেরাপি দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজেও সোরিয়াসিস ক্লিনিক চালু করা হয়েছে, যাতে দেশের যেকোনো স্থান থেকে রোগীরা একই মানের সেবা পান। আমরা রোগীদের জন্য বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য নিউজ বুলেটিনও তৈরি করেছি, যাতে তাঁরা নিজেরাই রোগটি সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে ও জানতে পারেন।’