মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

এমএসএফের প্রতিবেদন

অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা ৬৪১, গত বছরের চেয়ে ২৬% বেশি

চলতি বছর রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সর্বোপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলে মনে করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। এই মানবাধিকার সংগঠন বলেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসে দেশে বিরাজমান সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক, গণতান্ত্রিক, আইনি পরিবেশ ও মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল লক্ষণীয়ভাবে উদ্বেগজনক। মব সন্ত্রাস, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন, কারা হেফাজতে মৃত্যু—মানবাধিকারের এমন সব ক্ষেত্রে ২০২৪–এর তুলনায় এ বছর পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা গত বছরের চেয়ে এবার বেড়েছে ২৬ শতাংশ।

আজ বুধবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এমএসএফ। সেখানেই চলতি বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি উঠে এসেছে। এমএসএফ দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য প্রতি মাসে একটি করে মানবাধিকার প্রতিবেদন দেয়।

অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা ৬৪১

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৬৪১টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে ২২ শিশু, ৬ কিশোর ও ৭ কিশোরী, ১৫৭ নারী ও ৪১৫ পুরুষ। ৬০ বয়সের ঊর্ধ্বে ১৮ পুরুষ ও ৬ নারী রয়েছেন। ১০ জনের বয়স নিরূপণ করা যায়নি।

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় ছিল অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা, যা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হয়েছে। খুবই অল্পসংখ্যক অজ্ঞাতনামা লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হলেও বাকি লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এসব অজ্ঞাতনামা লাশ স্কচটেপ দিয়ে হাত-পা বাঁধা, রাস্তার ধারে পড়ে থাকা, বস্তাবন্দী, নদীর পানিতে ভাসমান, রেললাইনের ধারে বা খাল বিল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ভীতিকর বিষয়। এত পুলিশ এত টহল থাকে তারপরও অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বাড়ে কীভাবে? কেউ না কেউ তো এসব হত্যার সঙ্গে জড়িত। আর পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেও তারা এসব হত্যার সঠিক কারণ জানাতে পারে না।

মব সন্ত্রাস

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর অন্তত ৪২৮টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যা গত বছরের তুলনায় তিন গুণ। এসব ঘটনায় ১৬৬ জন নিহত ও ৪৬০ জন আহত হয়েছেন। ২২০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহত ১৬২ জনের মধ্যে চুরির অপবাদ বা সন্দেহে ৪১ জন, ডাকাতি অভিযোগে ও সন্দেহে ২২ জন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ২৫ জন, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ৮ জন, প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার অভিযোগে ১ জন, হত্যা মামলার অভিযুক্ত ৫ জন, চোরাকারবারি/মাদক ব্যবসায়ী অভিযোগে ৪ জন, সন্ত্রাসী নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ কর্মী সন্দেহে এবং রাজনৈতিক রোষানলের কারণে ৬ জন, মাদক কারবারি, কটূক্তি, চোরাকারবারি, অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ও সন্দেহে, জমিসংক্রান্ত বিরোধ, বাগ্‌বিতণ্ডা, মনোমালিন্য, যৌন হয়রানি, পূর্বশত্রুতা ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৫৪ জন রয়েছেন। গণপিটুনির ঘটনায় আহত ৪৬০ জনের মধ্যে ৫৫ জন আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ সদস্য।

মাজারে হামলা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মাজার এবং মুক্তচিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ২১টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিলেটের ৪টি মাজার, কুমিল্লায় ৪টি মাজার, ময়মনসিংহের গৌরীপুরে মাজারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মলমূত্র নিক্ষেপ করা, ঠাকুরগাঁয়ে মাজারে হামলা চালিয়ে ৩টি কবর ভাঙচুর করা। দিনাজপুর ঘোড়াঘাটে ওরস আয়োজনের প্রস্তুতির সময় একটি মাজারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রাজবাড়ীর দরবার শরিফ, রাজশাহীর খানকা শরিফ, নেত্রকোনায় পীরের আস্তানা, ময়মনসিংহে খানকা শরিফে অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ায় লালন ফকিরের আখড়ায় হামলার হুমকি, ময়মনসিংহে চার মাস আগে বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন ফকিরের জোরপূর্বক চুল কর্তনের ঘটনা, যা এ মাসে ভাইরাল হয়।

এমএসএফ বলেছে, যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা এবং সুফি মাজারে হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার কথা জানানো হয়েছিল। কার্যত এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। মাজার ও আখড়ায় হামলা মুক্তচিন্তা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বহন করে, যা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়।

সংখ্যালঘু নির্যাতন

এমএসএফ বলেছে, চলতি বছর ৯২টি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের শেষের দিকে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের চার্চসহ, স্কুল–কলেজের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ, ২১টি চার্চ ও ব্যক্তির কাছে উড়োচিঠি দিয়ে হুমকি সহিংসতার এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যশোরের অভয়নগরে একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মতুয়া সম্প্রদায়ের হিন্দু গ্রামে হামলায় ১৮টি এবং রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ধর্ম নিয়ে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ২১টি বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রংপুরের ঘটনায় অভিযুক্ত আটককৃত কিশোরকে নিরাপত্তার অজুহাতে এখনো জামিন দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়িতে এক আদিবাসী কিশোরী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংবাদমাধ্যমকে সেন্সর করা, মামলা নিতে পুলিশের অনীহা, মামলা নিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা দেরিতে করে আলামত নষ্ট করা, দুর্বল এজাহার করে আসামিদের জামিন নিশ্চিত করার মতো অভিযোগ উঠেছে। পরবর্তী সময়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে খাগড়াছড়িতে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র অবরোধ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বিকাশ ত্রিপুরা (২৬), চিংকেউ মারমা (২৬) ও উগ্য মারমা (২২) নিহত হয়েছেন। রামেসু বাজার এলাকায় আগুন দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত বসতবাড়ি ও ৪০টি দোকানে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম কারাগারে চিকিৎসার অভাবে লাল ত্লেং কিম বম (৩০) পাহাড়ি যুবক অসুস্থ হয়ে মারা যান।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের লঙ্ঘন

এ বছর সাংবাদিকদের যেভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং হত্যা, হয়রানি ও শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এমএসএফ। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ২৮৯টি ঘটনায় ৬৪১ জন সাংবাদিক দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হত্যা, হামলা, হুমকি, আইনি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৬৪। এ বছর আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে নিহত হয়েছেন ১ জন সাংবাদিক, ২৯৫ জন সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও হামলার শিকার হয়েছেন। লাঞ্ছিত ও হুমকির শিকার ১৬৩ জন সাংবাদিক, আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৭০ জন সাংবাদিক। আইনি হয়রানির শিকার সাংবাদিকদের নামে ৪৬টি মামলা হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ১২ জন। মামলাগুলোর মধ্যে ৭টি মামলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে আর অন্য মামলাগুলো হয়েছে সংবাদ প্রকাশকে কেন্দ্র করে বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, চাঁদাবাজি, মানহানি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে।

এ ছাড়া এ বছর ৯ জন সাংবাদিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, যাঁদের মধ্যে একজন নারীসহ ৫ জন সাংবাদিকের আত্মহত্যা, ২ জন দুষ্কৃতকারী কর্তৃক নিহত, ১ জন সড়ক দুর্ঘটনা এবং ১ জন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১৮ ডিসেম্বর রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অনেক সাংবাদিক আটকা পড়ে জীবন রক্ষার্থে চিৎকার করতে থাকেন, এ সময় সশরীরে ঘটনা ঠেকাতে গেলে নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করা হয়। দেশের অন্য কয়েকটি জেলাতেও প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। কোনো অবস্থাতেই ঘটনাগুলো গ্রহণযোগ্য নয়।’

কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, চলত বছর কারা হেফাজতে ১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছর মারা গিয়েছিলেন ১০৮ জন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ বছর ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে অসুস্থতার কারণে। ১ জন আত্মহত্যা, ১ জন গণপিটুনির পর কারা হেফাজতে মৃত্যু, ১ জন রহস্যজনক মৃত্যু ও নির্যাতনে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভারতীয় ২ জন নাগরিক কারাগারে অসুস্থতার কারণে মারা গেছেন। কারা হেফাজতে মৃত্যু হওয়া বন্দীদের মধ্যে কয়েদি ৪১ জন, হাজতি ৭৩ জন এবং ১ জন নারী হাজতি আত্মহত্যা করেছেন।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘এবারের মানবাধিকার পরিস্থিতি আমাদের বিস্মিত এবং হতাশ করেছে। সেই সঙ্গে ভীতও করেছে। কারণ, জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু উন্নতি তো দূরের কথা মব সন্ত্রাস কিংবা অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’