রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহতদের আনা হয়েছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে উপস্থিত হয়েছেন হতাহত শিশুশিক্ষার্থীদের স্বজনেরা। প্রিয় সন্তানের জন্য কান্না চেপে রাখতে পারছেন না অনেকে। দেখা যাচ্ছে এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহতদের আনা হয়েছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানে উপস্থিত হয়েছেন হতাহত শিশুশিক্ষার্থীদের স্বজনেরা। প্রিয় সন্তানের জন্য কান্না চেপে রাখতে পারছেন না অনেকে। দেখা যাচ্ছে এ রকম হৃদয়বিদারক ঘটনা

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট

সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন মুখের সারি; কারও গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু, কেউ ডুকরে কাঁদছেন

সোমবার সন্ধ্যা। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনে তখন চিৎকার, কান্না, আহাজারি আর রক্তের জন্য আকুতি। সব মিলিয়ে সেখানকার বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল। জরুরি বিভাগ দিয়ে ভেতরে পা দিতেই চোখে পড়ে উদ্বিগ্ন মুখের সারি। অনেকেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউবা মুঠোফোনে বারবার ফোন করে জানতে চাইছেন প্রিয়জনের খবর। কারও মুখে অশ্রু, কারও চোখে অজানা আতঙ্ক। সবার মুখে মুখে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা।

হেল্পডেস্কের সামনে কাঁদতে দেখা যায় মধ্যবয়সী এক নারীকে। তাঁর ছেলে মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বোরহান উদ্দিন। ছেলের ছবি দেখিয়ে জানতে পারেন, ছেলে বার্ন ইনস্টিটিউটেই রয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বোরহানের মা বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভিতু। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সকাল আটটার দিকে বের হয়েছে। আমি আমার ছেলেকে একটু দেখতে চাই এক পলক।’

হঠাৎ একটি কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে মধ্যবয়সী একজন পুরুষ কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লেন। তাঁকে ধরে রেখেছেন আরেক ব্যক্তি। তিনি জানালেন, কাঁদতে থাকা ব্যক্তির নাম রুবেল, তাঁর স্ত্রীর বোনের স্বামী। মাত্রই ছেলে তানভীর আহমেদের মৃত্যুসংবাদ শুনে ভেঙে পড়েছেন তিনি।

বেসরকারি চাকরিজীবী রুবেলের দুই ছেলেই মাইলস্টোন স্কুলে পড়ত। বড় ছেলে তানভীর অষ্টম শ্রেণিতে, ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে। ছোট ছেলে সুস্থ থাকলেও বড় ছেলেকে আর ফিরে পাননি। ছেলের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না রুবেল।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা চলছে তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়। এর মধ্যে চতুর্থ তলায় আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)।

লোকজনে ঠাসা লিফটে উঠতেই দেখা গেল এক কোণে ডুকরে কাঁদছেন মধ্যবয়সী এক নারী। লিফট থামল চতুর্থ তলায়। সেখানে নামতেই দেখা গেল, ফ্লোরজুড়ে উদ্বিগ্ন মুখ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ কাঁদছেন। অপেক্ষমাণ একটি কক্ষে বসে আহাজারি করছিলেন কয়েকজন নারী। আইসিইউর সামনে স্বজনদের ভিড়। কেউ কেউ দরজার ফাঁক দিয়ে একনজর প্রিয়জনকে দেখার চেষ্টা করছেন।

অন্যান্য দিনের মতো সোমবার সকালে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন প্রিয় সন্তানকে। স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সেই সন্তানের করুণ পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না স্বজনেরা। তাঁদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট 

প্রবেশমুখের এক পাশে একটি সাদা বোর্ডে কালো কালি দিয়ে লেখা—মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের নাম ও আইসিইউ বেড নম্বর। লেখা আছে:

শায়ান ইউসুফ ৯৫ শতাংশ (দগ্ধ), মাহতাব ৮৫ শতাংশ, মাহিয়া তাসনিম ৫০...এমন নয়টি নাম। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালি মারাত্মকভাবে পুড়ে গেছে।

বোর্ডের পাশেই সজল চোখে কানে ফোন ধরে আছেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। বললেন, ‘আমার অবস্থা ভালো না। আমার ছেলেটা আইসিইউতে।’ ফোন নামিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। জানালেন, তিনি সায়ান ইউসুফের বাবা—মোহাম্মদ ইউসুফ। নিজেও মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ক্যাম্পাসে তিনি ক্লাস নেন। আর ছেলে সায়ান পড়ত দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। বিকেলে খবর পান, ছেলে দগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ মেডিকেলে ভর্তি, সেখান থেকে আনা হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে।

আইসিইউর প্রবেশমুখের সামনেই হাসপাতালের জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি। সেখানেও স্বজনদের ভিড় আর আহাজারি। এক কোণে স্ট্রেচারে বিছানার চাদর মুড়িয়ে দেওয়া এক বৃদ্ধের লাশ পড়ে আছে। পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তাঁর স্বজন। তবে বৃদ্ধ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত নন।

হাসপাতালের বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে স্বেচ্ছাসেবী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। কেউ পানি, স্যালাইন, শুকনো খাবার বিতরণ করছেন। হাসপাতালের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের প্রবেশ রোধে কাজ করছেন।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়। তাদের খবর শুনে ছুটে এসেছেন স্বজনেরা। তাঁদের চোখে মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কারও কারও মাঝে আছে স্বজন হারানোর বেদনা 

রক্ত দিতে আসা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। হাসপাতালের এক পাশে দাঁড়িয়ে মাইকিং করে বলা হচ্ছে—‘এই মুহূর্তে রক্তের প্রয়োজন নেই। আপনারা পরে যোগাযোগ করুন।’ তবু কেউ কেউ সরছেন না। দাঁড়িয়ে থাকছেন, হয়তো রক্তের জন্য আবার ডাক আসতে পারে—সেই ভাবনায় অপেক্ষা করছেন তাঁরা। এমনই একজন আসাদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার রক্তের গ্রুপ “ও পজিটিভ”। এখন না লাগুক, পরে তো লাগতেই পারে। বাচ্চাগুলা তো শেষ হয়ে গেল ভাই।’

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ফটকে আবারও সাইরেন বাজিয়ে ঢুকছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। স্বেচ্ছাসেবকেরা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যান সড়কের বাড়তি ভিড় সরাতে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। কিন্তু বার্ন ইনস্টিটিউটের ভেতরে যেন সময় থেমে আছে। একেকটি পরিবার ছুটে চলেছে এক ওয়ার্ড থেকে আরেক ওয়ার্ডে—প্রিয়জনের খোঁজে। ডাক্তার-নার্সদের চোখেমুখে ক্লান্তি স্পষ্ট, তবু কেউ দম নিচ্ছেন না।