Thank you for trying Sticky AMP!!

রং নাম্বারের এক ফোন বদলে দিয়েছে কাজল খানের ১৮ বছরের গৃহবন্দী জীবন

‘শুধু এটুকু জানি, আমাকে হারলে চলবে না’

ছোট দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে বাড়ির ছাদে উঠেছিলেন কাজল। ঘুড়িটা আকাশের দিকে উড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবন যে ‘খাদে’ পড়ে যাবে, তা তাঁর দূর কল্পনাতেও ছিল না। পা পিছলে পড়ে যান ছাদ থেকে মাটিতে। এরপর মিটফোর্ড হাসপাতাল। সেই থেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে মাসের পর মাস ধরে চলে চিকিৎসা। একপর্যায়ে আশা ছেড়ে দেয় পরিবার। আর কাজলের জীবন তলিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে। দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে কাজলের ডান চোখের কর্নিয়ায় রক্তক্ষরণ হয়, ছিঁড়ে যায় বাঁ চোখের রেটিনা। দ্রুত কমতে শুরু করে দৃষ্টিশক্তি। ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে চেনা পৃথিবীটা।

ছোট ছোট জিনিস আর দেখতে পারছিলেন না কাজল, বইয়ে কালির লেখা পড়তে পারা তো দূরের কথা। ফলে ঘরের মধ্যে স্বাভাবিক চলাফেরার সময়ও এটা-সেটার সঙ্গে আঘাত পেতেন। শুরু হয় বিষণ্নতা।

১৯৯৮ সালে দুর্ঘটনার সময় কাজল তখন সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছিলেন। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, কাজল অন্ধত্বের দিকে চলে যাচ্ছেন এবং এখান থেকে ফেরার সুযোগ নেই। তবু শেষ ভরসা হিসেবে কাজলকে তাঁর মা জোছনা খান ২০০৩ সালে ভারতের মাদ্রাজে নিয়ে যান অস্ত্রোপচারের জন্য। মাঝে চলে যায় পাঁচ বছর।

মাদ্রাজে অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় কাজল এখন ‘লো ভিশন’-এর ব্যক্তি। তবে প্রতিবছর একবার করে তাঁর চোখের পরীক্ষা করাতে হবে; তাহলে বর্তমানের দৃষ্টিশক্তিটুকু ধরে রাখা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কাজলের অল্প আয়ের পরিবারের পক্ষে তা আর সম্ভব হয়নি। ফলে কাজলের চোখের চিকিৎসা থেমে যায় ২০০৩ সালে অস্ত্রোপচারেই।

হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার ঘটনায় কাজল এমনই আঘাত পেয়েছিলেন যে সবার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাসায় কেউ এলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতেন ঘরের কোণে। এভাবে কাজল ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে স্বেচ্ছা গৃহবন্দী জীবন কাটিয়েছেন বলে জানালেন প্রথম আলোকে। ২০১৫ সালে হঠাৎ একদিন তাঁর মুঠোফোনে একটা ফোন আসে। দু-এক কথা বলার পর দুজনই বুঝতে পারেন ভুল নম্বরে (রং নাম্বার) ফোন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি কাজলের ব্যাপারে আরও জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং জানতে পারেন যে কাজল ‘লো ভিশন’-এ গৃহবন্দী মানুষ।

কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সময় কাজল খানের ছবি তুলে রেখেছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক

সেই ব্যক্তি উৎসাহিত করতে থাকেন কাজলকে নতুন করে লেখাপড়া শুরু করতে। প্রথম আলোর কাছে কাজল ওই ব্যক্তির পরিচয় জানালেও তা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কাজল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই ব্যক্তি আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দেন বাংলাদেশ অ্যাডভোকেসি নেক্সাস-বি স্ক্যানের প্রেসিডেন্ট সাবরিনা সুলতানা এবং ভিজ্যুয়াল ইমপিয়ারড পিপল সোসাইটি-ভিআইপিএসের নাজমা আরা বেগম আপার সঙ্গে। তাঁরা এগিয়ে আসেন সহযোগিতায়। আবার শুরু করি পড়ালেখা। এখনতো কিছু প্রযুক্তি হয়েছে, কিন্তু ২০১৭ সালে “জি বোর্ড” ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। আমি শুনে শুনে পড়ি।’

কাজল গৃহবন্দী জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়ান ২০১৬ সালে। ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মতো বইয়ের পাতা খুলে বসেন তখন। এরপর ২০১৭ সালে সে রাজধানীর আগারগাঁও আদর্শ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০২০ সালে ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। এখন তিনি একই কলেজের বিএসএস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

তবে কাজলের জীবনের গল্পটা এভাবেই চলছে, তা নয়। কাজলের দুর্ঘটনার আগেই তাঁর বাবা মো. রফিক খান মারা গেছেন। সংসারের হাল ধরেছিলেন কাজলের মা জোছনা খান আর বড় ভাই মো. জহিরুল ইসলাম খান। তবে এই ভাই মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান ২০২১ সালে। ছোট ভাই মো. ওয়াসিম খান মারা যান আরও কম বয়সে; ২০১৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। রাজধানীর বঙ্গবাজারে কাপড়ের ব্যবসা ছিল পরিবারটির। কিন্তু পরপর এত দুর্ঘটনায় পুরোপুরি ভেঙে যায় আর্থিক সংগতি। দুই বোনের বিয়ে হয়। তাঁদের একজনের সঙ্গে থাকেন কাজলের মা। কিন্তু কাজল হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ একা।

ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েও নিজের আত্মমর্যাদায় আটকায় বোনের পরিবারে বোঝা হয়ে থাকতে। তাই অনেক চেষ্টা করে একটি সিট জোগাড় করতে পেরেছেন রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের হোস্টেলে।

নিজের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কাজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি না অন্ধ, না দেখতে পাই স্পষ্ট। তীব্র আলো বুঝি, গাছ আছে, মানুষ আছে বুঝতে পারি, কিন্তু অবয়বটা অনির্দিষ্ট। পত্রিকার হেড লাইন আগে একটু একটু পড়তে পারতাম। এখন তা–ও পারি না। সবকিছু সাদা দেখায়।’

আর্থিক সংকট আর দৃষ্টির সংকট নিয়ে কাজল কম্পিউটার শিখছেন, আবৃত্তি করছেন, নাট্য সংগঠনে অভিনয় করছেন, নিয়েছেন রেডিও জকি হওয়ার প্রশিক্ষণ। কিন্তু কাজলের মাসিক আয় মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা। প্রথম আলোকে বললেন, ‘ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি। একটা জরুরি নম্বর বের করতে পারি না। হাতড়ে হাতড়ে যাই এখান থেকে সেখানে, কিন্তু আমার স্বপ্নটা অনেক বেশি। কম্পিউটার শিখি সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ডে। সেখান থেকে মাসে যে বৃত্তি দেয়, সেটাই আয়। কিন্তু কারও কাছে আমি গলগ্রহ হতে চাই না।’

সরকারের ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ডে যোগাযোগ করা হলে প্রশিক্ষক মো. রাসেল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর ধরে কাজল কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্টের কাজ শিখেছেন নিজের আগ্রহে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং, কল সেন্টারের কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। তবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে কোর্সটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত তখন মাসোহারাও পাবেন না কাজল।’

কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখতে পান না কাজল। তবু হোস্টেল কম্পাউন্ডের ভেতরের গাছগুলো তাঁর ভালো লাগে। তাই প্রায়ই যান সেখানে

এমন পরিস্থিতিতেও কাজল থেমে নেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তৈরি ‘সুন্দরম’-এর সদস্য তিনি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্পে কাজ করছে সুন্দরম। সেই প্রকল্পের অংশ হিসেবে চলছে নাটকের অনুশীলন। কাজল মিরপুর থেকে রোজ শিল্পকলা একাডেমিতে বাসে করে আসছেন অনুশীলন করতে। প্রথম আলোকে কাজল বললেন, ‘বাস কখনো কখনো শিল্পকলার ফ্লাইওভারের কাছে (মৎস্য ভবন–সংলগ্ন) নামিয়ে দেয়। তখন হেঁটে হেঁটে ওটা পাড় হওয়া যে কি কষ্টের, বোঝাতে পারব না! আমি তো ভালোভাবে কিছুই দেখি না। বারবার ভুল হয় আর আঘাত পাই। তবু শিল্পী হওয়ার ইচ্ছাটা যায় না।’

কাজলের সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় সুন্দরম নাট্যগোষ্ঠীর প্রশিক্ষক সৌদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজলের খুব নিষ্ঠা আছে। নিয়মিত অনুশীলনে আসেন। তবে কাজল অন্তর্মুখী। নিজের খারাপ লাগা বা প্রতিবন্ধকতা সহজে প্রকাশ করতে চান না। ফলে অনেক সময় তাঁকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় বুঝতে কষ্ট হয়।’

আগামী ফেব্রুয়ারিতে কাজলের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সের মেয়াদ শেষ হলে আয়ের কোনো পথই থাকবে না। তখন কী করবেন, জানতে চাইলে কাজল কিছুটা অসহায় হয়ে পড়েন। বলেন, ‘জীবনটা সেই যে বদলে গেল ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে। আমার সেই ভাইয়েরাও চলে গেল কত দ্রুত! তবু খুব ইচ্ছা করে সুন্দর করে বাঁচতে। রং নাম্বার থেকে পরিচয়ের ব্যক্তি কোর্সে ভর্তির জন্য যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন। আর্থিক সুবিধা নিইনি। এত কষ্টের পরও নতুন কিছু শিখতে ইচ্ছা করে আমার। কিন্তু চিকিৎসার অভাবে দৃষ্টি আরও দ্রুত কমে যাচ্ছে। আসলে জানি না, কী হবে সামনে। শুধু এটুকু জানি, আমাকে হারলে চলবে না।’