
ভিক্ষাবৃত্তি করুণা বা অনুগ্রহনির্ভর পেশা; কিন্তু তা সহজ নয়। মানুষের মন গলিয়ে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভিক্ষুকদের জীবন চালাতে হয়। সমাজের নিচু স্তরে বাস করে বলে তাঁদের সঙ্গে নানা পদের মানুষের সাক্ষাৎ ঘটে। এ সাক্ষাৎ তাঁদের জীবনবীক্ষা তৈরি করে। মানুষ তাঁদের আধার, পথ তাঁদের আধেয়।
রাজনীতির গভীর অভিঘাত ভিক্ষুকের জীবনেও পড়ে। তবে সে অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাঁদের হয়ে কাজটি করতে হয় অন্যদের। অন্যদের দিয়ে সে কাজ যথাযথভাবে করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর জগৎখ্যাত প্রবন্ধ ‘ক্যান সাবঅলটার্ন স্পিক’-এ (‘নিম্নবর্গ মানুষ কী কথা বলতে পারে’)।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে শুনতে হবে। অন্তর্ভুক্তি আর সংযোগ ছাড়া জুলাইয়ের চেতনা বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।
গায়ত্রী উদাহরণ দিয়ে বলেন, উপনিবেশ আমলে সতীদাহ প্রথাকে ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকেরা মহৎ করে উপস্থাপন করেছেন। সেই উপস্থাপনায় সহমরণের শিকার নারীদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। সেখানে নারীদের বাস্তবতা নেই। অথচ নারীদের বয়ান শোনা জরুরি ছিল।
ভিক্ষুকের কণ্ঠ, চিন্তা ও ভাষ্য যথাযথভাবে তুলে আনা সহজ নয়। কারণ, এর সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি, ভাষা ও ভাবের গভীর সংযোগ রয়েছে। প্রচলিত ভাবনায় ভিক্ষুকদের চিন্তার গভীরতা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। এ সংশয় ন্যায্য নয়। সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ভিক্ষুকদের দারুণভাবে ঋদ্ধ করে।
এ লেখার জন্য ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকার মোট ১৮ জন ভিক্ষুকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁদের ৮ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ। ভিক্ষুকেরা একটি সংবেদনশীল পক্ষ। তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে নৈতিক মানগুলো অনুসরণ করা হয়েছে। ভিক্ষুকদের কাছ থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো।
রাজনৈতিক ভাবনা
ভিক্ষুকদের রাজনৈতিক ভাবনায় বাস্তবাদিতা ও ভাববাদিতার মিশেল লক্ষ করা গেছে। তাঁদের অভিমত, রাজনীতি ঠিক না হলে ‘দ্যাশ’ ঠিক হবে না। অর্থাৎ, দেশ পরিচালনায় রাজনীতি যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা তাঁরা ভালোই আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু ভিক্ষুকদের পাল্টা প্রশ্ন, রাজনীতি ঠিক করবে কে? ‘দ্যাশ’ ঠিক করবে কে? তাঁরা মনে করেন, অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশ এখন অভিভাবকহীন। আরেক অংশের বক্তব্য, দ্যাশ এখন আল্লাহ চালাচ্ছেন। দেশে যে একটি সরকার আছে, রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে ভিক্ষুকেরা তা অনুভব করতে পারছেন না।
ভিক্ষুকেরা নির্বাচিত সরকার চান
ভিক্ষুকেরা নির্বাচিত সরকার চান। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার না থাকায় দেশের সার্বিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়রোজগার কমে যাচ্ছে। এটি তাঁদের জীবনকেও প্রভাবিত করছে। তাঁরা মনে করেন, জনপ্রতিনিধি থাকলে দুটো কথা বলা যায়। এখন সমস্যা নিয়ে তাঁরা কার সঙ্গে কথা বলবেন, তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
ভবিষ্যতে ভোট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ভিক্ষুকেরা সংশয়ী। তাঁদের মত হলো, গত ১৫ বছর তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। কেউ কেউ কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন, তাঁদের ভোট অন্যেরা দিয়ে গেছে। তাঁদের মন্তব্য, ভোট দেওয়ার অধিকার ছাড়া তাঁদের আর বিশেষ কিছু নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে
বর্তমান সরকারের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিক্ষুকেরা জানান, ‘শেখের বেটি’ চলে যাওয়ার পর ‘ডা. ইউনূস’ দেশ চালাচ্ছেন। তাঁরা সম্বোধন করেছেন ‘ডাক্তার’। অন্তর্বর্তী সরকার যে ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছেন সে খবরও কোনো কোনো ভিক্ষুক রাখেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামনে ভোলা থেকে আসা একজন ভিক্ষুক বললেন, ‘তিনি তো আমাদের লোক।’ এ কথার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জামাত করি। উনি তো আমাদের কথা শোনেন।’ ১৮ জন ভিক্ষুকের বেশির ভাগই মনে করেন ‘দ্যাশ’ ঢিলেঢালাভাবে চলছে। এভাবে ‘দ্যাশ’ চলতে পারে না।
শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে
শেখ হাসিনা সম্পর্কে ভিক্ষুকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, শেখ হাসিনার জবরদস্তিমূলক শাসনের কারণে দেশের আজ এ অবস্থা। কয়েকজন মনে করেন, শেখ হাসিনা কিছু ভালো কাজ করেছেন; কিন্তু তাঁর কাছের লোকেরা ‘সর্বনাশ’ করেছেন। শেখ হাসিনা ভিক্ষুকদের জন্য যে ভাতার ব্যবস্থা করেছেন, তা থেকে তাঁরা উপকার পাচ্ছেন বলে জানান। কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, তাঁরা মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পান। নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এ টাকা সমাজসেবা অধিদপ্তর তিন মাস পরপর তাঁদের দিয়ে থাকে।
ভাতা প্রদানে জেন্ডার–বৈষম্য
রাষ্ট্র ও জীবন নারী ও পুরুষের যে সমান নয়, তা আবারও স্পষ্ট হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নারী ভিক্ষুকেরা ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন। নারী ভিক্ষুকদের অভিমত, তাঁদের তদবির করার মতো কেউ নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরে গেলে কেউ তাঁদের কথা শোনেন না, পাত্তা দেন না।
‘হামার ছাওয়া দ্যাশ নতুন করে স্বাধীন করেছে’
রংপুর থেকে আসা এক নারী ভিক্ষুক সাক্ষাৎকারকালে বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘হামার ছাওয়া আবু সাঈদ নতুন করে “দ্যাশ” স্বাধীন করেছে। আবু সাঈদকে পুলিশ যেদিন গুলি করে হত্যা করল, তারপর সারা দেশের পরিস্থিতি বদলে গেল।’
গণ-আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে একজন নারী ভিক্ষুকের সংযোগবোধ এক বিশেষ চিহ্ন ভাবা যায়। এ সংযোগবোধের বিশেষ মূল্যও রয়েছে। এ সংযোগবোধ যত দিন রয়েছে, তত দিন এ গণ-আন্দোলনের মর্মবাণী জীবিত থাকবে। তবে এ অনুভবকাঠামোর সঙ্গে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যাশা পূরণ না হলে চেতনার অবসান ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
নির্ভীকতা ও আত্মসম্মান
ভিক্ষুকেরা জানিয়েছেন, এখন তাঁদের ভয় লাগে না। খুব সহজেই তাঁরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে পারেন। কেউ তাঁদের হয়রানি করে না। তাঁদের আয় কমেছে সত্য, তবে ভয়ও কেটেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অবনতি তাঁদের জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় তাঁদের আয়হীন দিন কাটাতে হয়েছে।
অন্যের কাছে জীবিকার জন্য হাত পাতলেও ভিক্ষুকেরা তা আত্মসম্মান বজায় রেখেই করতে চান। ভোলা থেকে আসা এক ভিক্ষুক জানান, তিনি থাকেন কারওয়ান বাজারে, কিন্তু ভিক্ষা করেন আগারগাঁওয়ে। কারওয়ান বাজারের মতো বাণিজ্যিক এলাকায় আয়রোজগারের সুযোগ বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি আগারগাঁওয়ে ভিক্ষা করেন? জবাবে তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারে তাঁর এলাকার অনেক পরিচিত লোক ব্যবসা করে। পরিচিত লোকের সামনে কি ভিক্ষা চাওয়া যায়? মানসম্মান বলে একটা কথা আছে না? নিজ পরিসরে আত্মসম্মানটুকু বজায় রেখেই তাঁরা ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যেতে চান।
পরার্থবোধ ও বেঁচে থাকা
ভিক্ষুকদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা কাঠামো অপ্রতুল। মানুষের পরার্থবোধ ও দানের মানসিকতা ভিক্ষুকদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত এক নারী ভিক্ষুক জানালেন, মোহাম্মদপুরের নবোদয় কাঁচাবাজারে নাসিমা ফার্মেসির কাছে তিনি ঋণী। দোকানিরা তাঁকে তিন বেলা খাবার দেন। দিন শেষের আয় দিয়ে ওষুধের পয়সা হয় না। যতটুকু পারেন দেন, বাকিটা তাঁরা চান না। দোকানের দুই ভাই দু-তিন বছর ধরে এভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন। অন্যের পরার্থবোধের ছোঁয়ায় এভাবে অনেকে বেঁচে আছেন। সমাজে ভরসার বড় জায়গা পরার্থবোধ। এর পরিধি যত বাড়বে অসহায় ব্যক্তিরা তত সুরক্ষা পাবেন।
ভিক্ষুকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব লক্ষ করা গেছে। একজন শারীরিক এবং দুজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জানান, তাঁরা একসঙ্গে সারিবদ্ধভাবে ভিক্ষা করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক তাঁদের পথ দেখান। দিন শেষে তিনজনের আয় সমানভাবে ভাগ করা হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা স্বজ্ঞা দিয়ে নিজের হিসাব বুঝে নেন। এতে তাঁদের মধ্যে কোনো বঞ্চনাবোধ নেই।
পরিবার-স্বজন-সন্তান
সাক্ষাৎকারে ১০ জন ভিক্ষুক জানান, তাঁরা পরিবারসহ ঢাকায় বাস করেন। অনেকের পরিবারে আয়ের উৎস একাধিক। ৮ জন জানান, তাঁরা ঢাকায় একা থাকেন। স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পারিবারিকভাবে বন্ধনহীন। পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে তাঁদের অভিমত হলো, সম্পর্কগুলো হালকা হয়ে যাচ্ছে। শহরে অনেক বড় বড় ভবন উঠছে, কিন্তু মানুষের মান নেমে যাচ্ছে।
শান্তি ও সম্প্রীতির প্রত্যাশা
কেমন দেশ চান, জানতে চাইলে ভিক্ষুকেরা জানান, তাঁরা শান্তিপূর্ণ দেশ চান। তাঁরা একসঙ্গে বাস করতে চান। মারামারি ও হানাহানি চান না। কারণ, পরিস্থিতি অস্থির হলে তাঁদের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ে। দেশে তাই শান্তি ফিরে আসা দরকার।
ভিক্ষাজীবী ও বৈষম্যহীনতার স্বপ্ন
প্রথম আলো জানাচ্ছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জন শহীদের মধ্যে শ্রমজীবীর সংখ্যা ২৮৪। শ্রমজীবী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, ট্রাকচালক ও তাঁর সহকারী, দোকানের কর্মী, রেস্তোরাঁর কর্মচারী ও পোশাক কারখানার কর্মীদের মতো আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা (প্রথম আলো, ১৯ জুলাই, ২০২৫)।
অবস্থানগত দিক থেকে শ্রমজীবী ও ভিক্ষুকদের মধ্যে তফাত খুব বেশি নয়। প্রান্তিক মানুষের আত্মত্যাগের মূল প্রেরণা ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। দিন যত গড়াচ্ছে, সেই আকাঙ্ক্ষা দুরাশার পথ ধরছে। ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে কেবল রাজনৈতিক দলের কথা শোনা হচ্ছে, তাদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষদের শোনার ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ-উদ্যোগ নেই।
সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে শুনতে হবে। অন্তর্ভুক্তি আর সংযোগ ছাড়া জুলাইয়ের চেতনা বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ভিক্ষুকদের জীবনমানে পরিবর্তন এলে এ গণ-অভ্যুত্থান সার্থক হবে।
খান মো. রবিউল আলম: যোগাযোগ-পেশাজীবী; শিক্ষক