
পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন সাংবাদিক পিটার আর কান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। ওই সময় প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখা পাঠানোর সুযোগ না পেয়ে দিনপঞ্জি রাখতে শুরু করেন তিনি। কয়েক দিনের দিনপঞ্জি একসঙ্গে পাঠালে তা প্রকাশ করত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ওয়াল স্টিট জার্নাল তাঁর দিনপঞ্জি প্রকাশ করে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য আজ তাঁর ১২ ডিসেম্বরের দিনপঞ্জি তুলে ধরা হলো।
পুরো দিনের জন্য কারফিউ কার্যকর হয়েছে। শহর পুরোপুরি স্থবির হয়ে আছে, যেন এক মহামারিতে হুট করেই শুধু চারদিকে উড়ে বেড়ানো কালো কাকগুলো বাদে সব জীবন্ত প্রাণী উবে গেছে। অবশ্যই, এই শহরের একমাত্র মহামারি এখন ভয়।
মাথার ওপর সি১৩০ চক্কর দেওয়ার শব্দে আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মনে হলো নারী ও শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ বিমান সত্যি সত্যিই এসে গেছে। যদি বিমানগুলো ঢাকা ত্যাগ করতে পারে, তবে এই ডায়েরিও হয়তো তাদের সঙ্গে চলে যাবে।
হলিক্রস কলেজের ফাদার টিম ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে পৌঁছান ৯টা ১৫ মিনিটের দিকে, মূলত সবাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু সদ্যই খবর এল যে বিশেষ ফ্লাইট ঢাকায় পৌঁছে যাওয়ার পথে রয়েছে। বিদেশিরা বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফাদার বললেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি যে নববধূ একা বেদিতে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন বোধ হয়।’ বিশেষ বিমানে যাওয়ার জন্য যেসব বয়স্ক আমেরিকান দম্পতি তালিকাভুক্ত ছিলেন, তাঁরা বিমানবন্দরের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন।
এক পুরুষের মাথায় ছিল অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি হ্যাট, নারীর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা ছিল একটি খাঁচা, যাতে ছিল দুটি ময়না পাখি। তিনি বললেন, ‘আমাকে আমার কুকুর ছেড়ে যেতেই হচ্ছে। এটি ভয়ানক।’
বিমানবন্দরে ব্রিটিশ কূটনীতিকেরা ও অন্য স্বেচ্ছাসেবীরা গাছের ডাল দিয়ে রানওয়ে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন, এভাবেই সরানো হচ্ছিল শার্পনেল। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর সি১৩০ উড়োজাহাজ অবতরণের চেষ্টা চালায় বেশ কয়েকবার; অবশেষে ঝুঁকি নিয়ে বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রানওয়েতে অবতরণ করে। কমলা রঙের ধুলোর মধ্যেই নিরাপদ অবতরণ হয়। যেতে চাওয়া ব্যক্তিরা জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠেন এবং হাততালি দিলেন। প্রপেলার ঘুরছিল, তবু তার মধ্যেই গমনেচ্ছু ব্যক্তিরা বিমানের দিকে দৌড়ে গেলেন এবং ওঠা শুরু করলেন। সবকিছু বেশ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হলো। প্রথম বিমানে নারী ও শিশুরা উঠল এবং এভাবেই চলতে থাকল।
ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের লোকেরা বিমানে বড় বড় স্যুটকেস তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু নির্দেশনা হলো, ‘শুধু ১০ কেজি নেওয়া যাবে।’ এটি সত্যিই বিস্ময়কর যে মানুষ কীভাবে তাদের জিনিসপত্রের মায়ায় জড়িয়ে যায়; এমনকি শেষ বিমানের শেষ যাত্রীটিও স্যুটকেস নিয়ে ব্যস্ত ছিল, যেখানে কিনা অতিরিক্ত ৩০ সেকেন্ড সময়ের অর্থ হলো আপনার বিমান ছেড়ে চলে যেতে পারে! কারও কারও চোখ ছিল অশ্রুভেজা এবং কেউ কেউ আবেগমথিত হয়ে পড়েছিল।
দেখা গেল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মেজর তাঁর স্ত্রীকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমেরিকান এক কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলেন। উত্তর ছিল ‘না’ এবং পাকিস্তানি ওই সেনা কর্মকর্তা ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে গেলেন। সোভিয়েত কনসাল জেনারেল ছিলেন উৎফুল্ল চিত্তে। তিনি বললেন, ‘আমি খুশি যে আমার সঙ্গী বিমানে উঠে গেছে।’
বিমানবন্দরে প্রতীকী অবস্থান ছিল পাকিস্তানিদের, ভাঙা কাচ ও অন্যান্য ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একজন অভিবাসন কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে ছিলেন গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের পাসপোর্টে সিল দেওয়ার জন্য। কিন্তু এটি বিশেষভাবে ব্রিটিশদের একক কর্মকাণ্ড। এক ব্রিটিশ সহকর্মীকে আরেক জার্মান টেলিভিশন প্রতিবেদক বললেন, ‘এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন তোমরা ব্রিটেনের যুদ্ধে জিতেছিলে।’ চারটি সি১৩০ বিমান অবশেষে চার ঘণ্টা সময়ে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে উড্ডয়ন করল, যেসব বিদেশি যেতে চেয়েছিল, তাদের প্রায় সবাইকেই নিয়ে গেল বিমানগুলো।
বিমানগুলো চলে যাওয়ায় হোটেলটি আশ্চর্যজনকভাবে অনেকটাই শান্ত হয়ে এল। বাকি বিদেশিরা, যাঁদের বেশির ভাগই সাংবাদিক—তাঁরা বিকেলটা কাটালেন সুইমিংপুলের পাশে। তাঁরা ওয়াটার পোলো ও সকার খেললেন এবং কাকের দিকে ময়লা ছুড়ে সময় কাটালেন।
বিবিসি রেডিওর সংবাদে প্রতি ঘণ্টায় পাওয়া যাচ্ছিল নিত্যনতুন খবর। ভারতীয়রা ঢাকার কাছাকাছি চলে আসছে, নদী অতিক্রম করছে, ধারণা করা হচ্ছে প্যারাস্যুট ইউনিটও নামিয়েছে। কিন্তু ঢাকা আছে কারফিউর মধ্যে এবং কেউ যুদ্ধের খোঁজে যেতে পারছে না। কেউ একজন পুলের পাশে বসে বই পড়ছিল, ‘সিক্স ডেজ ইন জুন: ইসরায়েলস ফাইট ফর সারভাইভাল’। গত ১০ দিন টিকে রয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, তবে বাজি হচ্ছে—আরও দুই সপ্তাহ টিকতে পারবে না। শহরের আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই এবং আগুন দেখা যাচ্ছে হোটেল থেকেই।
* ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির একাংশ আবার প্রকাশ করা হলো।