
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল উইপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন তখন পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আরও বলেছেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা পেয়েছিলেন তিনি। সেদিন থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়েছিল। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল মঙ্গলবার জবানবন্দি দিয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এই প্রথম কোনো আসামি অপরাধ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে জবানবন্দি দিলেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় (২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে) সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়। গত ১০ জুলাই তিনি এ মামলায় দোষ স্বীকার করে নিয়ে অ্যাপ্রুভার (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন ট্রাইব্যুনালে। তাঁর আবেদন সেদিনই মঞ্জুর করা হয়, তবে অ্যাপ্রুভার হিসেবে জবানবন্দি দিলেন গতকাল। তিনিসহ এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জন সাক্ষী জবানবন্দি দিলেন।
কারাগার থেকে গতকাল সকালে ট্রাইব্যুনালে আনা হয় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রবেশ করেন তিনি। যেখানে আসামিরা অবস্থান করেন, সেখানে বসতে দেওয়া হয় তাঁকে। বিচারকাজ শুরু হলে সাক্ষীরা যেখানে জবানবন্দি দেন, সেখানে তাঁকে নেওয়া হয়। তখন তাঁর হাতে কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। মাঝেমধ্যে তাঁকে কাগজে চোখ বোলাতে দেখা যায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে আসা নির্দেশের বিষয়টি কীভাবে জেনেছেন, সেটিও জবানবন্দিতে তুলে ধরেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তাঁকে ফোন করে জানান, আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তখন তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছিলেন। ওই সময় তাঁর সামনে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। পরে এই নির্দেশনা তৎকালীন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ সারা দেশে পৌঁছে দেন প্রলয়। ওই দিন থেকেই মারণাস্ত্র ব্যবহার শুরু হয়।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, মারণাস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর ও ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশ ছিল, যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।
সাবেক আইজিপি বলেন, শেখ হাসিনাকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি করার বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে বিশদভাবে এসেছে। তথ্যানুসন্ধান দলটি ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার এবং সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার মারণাস্ত্র দিয়ে গুলি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও চিকিৎসা পেতে বাধা দেওয়ার মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল তৎকালীন সরকার।
হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নজরদারি, তাঁদের অবস্থান নির্ণয় ও গুলি করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। যার পরামর্শ দিয়েছিলেন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ।
আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলো ভাগ করে ‘ব্লকরেইড’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল উল্লেখ করে সাবেক আইজিপি বলেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও আহত করা হয়। আন্দোলন দমনে সরকারকে উৎসাহিত করেন আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও ব্যবসায়ীরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকাশিত সর্বশেষ গেজেট অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ৮৩৬ জন। আহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৮০০ জন।
গত বছরের ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জবানবন্দিতে জানান সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, সেই বৈঠকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবির প্রধান, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এনএসআইয়ের প্রধানসহ মোট ২৭ জন উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলন দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরছিল। কিন্তু চারদিকে পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়।
সেদিন (৪ আগস্ট) রাতের গণভবনে আবার বৈঠক ডাকা হয় বলেও জানান সাবেক আইজিপি। তিনি বলেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক ও সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব (মো. মজিবুর রহমান) উপস্থিত ছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন বৈঠকে। শেখ রেহানাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের প্রধান ও এসবির প্রধান বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন। সেই বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করবে।
ওই বৈঠক থেকে সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যান বলে জবানবন্দিতে জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, সেখানে (কন্ট্রোল রুম) তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিজিএফআইয়ের প্রধান, এসবির প্রধান ও মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা শহরের প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে ৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টায় সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে সবাই চলে যান।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরের নিজ কার্যালয়ে যান। ইতিমধ্যে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী এবং বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। সেদিন দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে তিনি জানতে পারেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন।
ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা কোথায় যাবেন, তা তাঁরা জানতেন না বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট, ২০২৪ সাল) বিকেলে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তাঁদের প্রথম তেজগাঁও বিমানবন্দরে এবং সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাঁর সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ক্যান্টনমেন্টে যান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার, এসবির প্রধান ও আমেনা বেগম (তৎকালীন ডিআইজি)। তার পরের পালায় তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, অতিরিক্ত ডিআইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে।
পরে গত বছরের ৬ আগস্ট আইজিপি হিসেবে তাঁর চুক্তি বাতিল করা হয় বলে জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালীন তাঁকে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ‘কোর’ কমিটির বৈঠক হতো। বৈঠকে আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো। কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি রাজি হন। আটকের দায়িত্ব তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুনকে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাঁদের আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাঁদের আত্মীয়স্বজনকেও ডিবিতে এনে চাপ দেওয়া হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
সাবেক আইজিপি বলেন, ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে ডাকতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। বিষয়টি জবানবন্দিতে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন পুলিশের আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ শেখ হাসিনাকে দিয়েছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী—এটি তিনি জানতে পারেন।
সরকারের পক্ষ থেকে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ওসি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সেই নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং তাঁরা সেটা বাস্তবায়ন করেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি। তিনি বলেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, র্যাব সদর দপ্তর পরিচালিত উত্তরাসহ র্যাব-১–এর কার্যালয়ের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাবের ইউনিটের অধীনে আরও অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো, যা একটা কালচারে (সংস্কৃতি) পরিণত হয়েছিল।
অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার মতো কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপারেশন) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকেরা সমন্বয় করতেন বলেও উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি।
র্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলেও শুনেছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, এই নির্দেশনাগুলো (গুম-হত্যার) সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারেন। এই নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড (শৃঙ্খলা) ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপারেশন) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো।
জবানবন্দিতে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। প্রত্যেক শহীদের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।’
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছেন। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কিন্তু তাঁর চাকরিজীবনে তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁর দায়িত্বকালে এত বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর দায় তিনি স্বীকার করছেন।
সাবেক আইজিপি বলেন, ‘আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরও হায়াত দান করেন, বাকিটা জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাব।’
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১–এ গতকাল সাক্ষ্য দিয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিকে ঢাকার আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোর ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে করা আরেকটি মামলার আসামি ও পুলিশের সাবেক উপপরিদর্শক শেখ আবজালুল হক অ্যাপ্রুভার হিসেবে জবানবন্দি দেবেন। তবে এই মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি।
জবানবন্দির পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সিদ্ধান্তগুলো রাষ্ট্রের কোন জায়গা থেকে, কীভাবে এসেছে, নির্দেশনা আসার পদ্ধতিগুলো কী ছিল, বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে কীভাবে হয়েছে, কোন ‘কমান্ড স্ট্রাকচার’ কীভাবে কাজ করেছে—এসব তথ্য সাবেক আইজিপি ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন।
সাবেক আইজিপির জবানবন্দির বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, এটি একটি অকাট্য ও অপ্রতিরোধ্য সাক্ষ্য। জুলাই-আগস্ট (২০২৪ সাল) শুধু নয়, গত ১৫-১৬ বছরে দেশে গুম-খুনসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, সে বিষয়ে একটি অকাট্য দলিল তিনি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছেন।
সাবেক আইজিপির জবানবন্দির বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান হিরো প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় রাজসাক্ষীর সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। বিগত বছরগুলোতে এরশাদ শিকদারের (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে) মামলা ছাড়া রাজসাক্ষী হয়েছেন, এমন নজির আছে বলে তাঁর জানা নেই।