ফেসবুক
ফেসবুক

টেলিযোগাযোগ আইনের সংশোধনী প্রস্তাব

সরকারের নির্দেশনা না মানলে ফেসবুককে ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে

ধরা যাক, সরকারের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি জাতীয় ঐক্য-সংহতির পরিপন্থী, দেশদ্রোহমূলক আধেয় (কনটেন্ট) ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। এই অপরাধে তিনি জামিন–অযোগ্য ধারায় শাস্তি পাবেন। এই অপরাধের দায় শুধু ব্যক্তির একার হবে না। তিনি ফেসবুকের মতো যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করবেন, সেই প্ল্যাটফর্মকে এই আধেয় সরাতে নির্দেশনা দেবে সরকার। তাৎক্ষণিকভাবে তা না সরালে প্ল্যাটফর্মকে ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর প্রস্তাবে এমন বিধানের উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই প্রস্তাব ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। যদিও এটি প্রস্তাব পর্যায়ে আছে, চূড়ান্ত হয়নি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কঠোর নজরদারি হতো। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারা ব্যবহার করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তবে বিটিআরসির প্রস্তাবে কিছু ক্ষেত্রে একই ধরনের বিষয় রয়েছে।

গত ২৮ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিটিআরসিকে টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রস্তাব প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়। এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার বিটিআরসি আইনে কিছু সংশোধনী এনে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

বাক্‌স্বাধীনতা ও প্রযুক্তি অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, আইনে এ ধরনের বিধান রাখা হলে আগের মতোই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

গত ২৮ জুলাই ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিটিআরসিকে টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ সংশোধন ও পরিমার্জনের প্রস্তাব প্রস্তুতের নির্দেশনা দেয়। এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার বিটিআরসি আইনে কিছু সংশোধনী এনে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

প্রস্তাবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর সংশোধনী (২০১০) রহিত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ বিটিআরসির ওপর মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের সুযোগ প্রস্তাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) লোগো

যেসব বিষয় প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইন্টারনেট বন্ধের সুযোগের ধারা বিলুপ্ত। আড়ি পাতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বিধান করা। আইন প্রয়োগের আওতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ডিজিটাল মাধ্যম ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে যুক্ত করা। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ পরিষেবার ট্রাফিক/ইন্টারনেট ডেটা সংগ্রহ, পর্যালোচনা করার কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিটিআরসির অনুমোদন সাপেক্ষে তরঙ্গ ভাগাভাগি, বিক্রয় বা ভাড়া দেওয়া।

প্রস্তাবে বিদ্যমান আইনের ৬৬ ধারা কিছুটা সংশোধন করে অপরাধ ও দণ্ডের বিধানে টেলিযোগাযোগ বা বেতার যন্ত্রপাতির পাশাপাশি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে যুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা বা প্রতারণামূলক তথ্য–উপাত্ত (কনটেন্ট) পাঠালে, প্রকাশ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কঠোর নজরদারি হতো। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারা ব্যবহার করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তবে বিটিআরসির প্রস্তাবে কিছু ক্ষেত্রে একই ধরনের বিষয় রয়েছে।

বিদ্যমান আইনের ৬৬ (ক) ধারা সংশোধন করে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্য-সংহতির পরিপন্থী, দেশদ্রোহমূলক, বিদ্বেষ-বিভেদ বা অস্থিরতা তৈরি করে, দেশের সার্বভৌমত্ব বা প্রতিরক্ষার জন্য ক্ষতিকর, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর বা দেশের জনশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর বা ভীতি তৈরি করে বা আর্থিক ক্ষতি করে—এমন কোনো সংকেত, বার্তা, কনটেন্ট যদি টেলিযোগাযোগ বা বেতার যন্ত্রপাতি বা ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে পাঠানো হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। শাস্তি হিসেবে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৩০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

একই ধারার বিষয়ে প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা ইন্টারমিডিয়ারি (মধ্যস্থতাকারী) বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যদি উল্লিখিত কাজ করে বা করতে সহায়তা করে, আবার সরকার যদি উল্লিখিত বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিটিআরসিকে লিখিত নির্দেশনা দেয়, তাহলে কমিশন কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই সেসব সংকেত, বার্তা বা কনটেন্ট বন্ধ বা অপসারণ করতে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নির্দেশনা দিতে পারবে। কমিশনের নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে পালন না করলে সেবা প্রদানকারীকে ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৩০০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। এখানে সরকার বলতে স্বরাষ্ট্র বা প্রতিরক্ষা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বোঝাবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রস্তাবে ৬৬ (ক) ধারা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। এটি রাখা ঠিক হবে না। কারণ, এ ধরনের বিধান রাখা হলে আগের মতো অপপ্রয়োগ হতে পারে। আগের বাতিল হওয়া তিনটি আইনেই এ রকম দেশবিরোধী বক্তব্যের দোহাই দিয়ে মানুষকে জেল দেওয়া হতো।
সাবহানাজ রশিদ দিয়া, নির্বাহী পরিচালক, টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট

বিটিআরসির প্রস্তাবে ৬৬ (ক) ধারাকে জামিন–অযোগ্য রাখা হয়েছে। তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ও প্রশাসনিক জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে তা আপসযোগ্য হবে।

এ বিষয়ে প্রযুক্তি অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ দিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবে ৬৬ (ক) ধারা অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। এটি রাখা ঠিক হবে না। কারণ, এ ধরনের বিধান রাখা হলে আগের মতো অপপ্রয়োগ হতে পারে। আগের বাতিল হওয়া তিনটি আইনেই এ রকম দেশবিরোধী বক্তব্যের দোহাই দিয়ে মানুষকে জেল দেওয়া হতো।

প্রস্তাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে দায়বদ্ধ রাখার বিষয়টিকে নীতিগতভাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সাবহানাজ রশিদ দিয়া। তবে তিনি বলেন, নির্দেশনা তাৎক্ষণিকভাবে না মানলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে বলে যে কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বাস্তবায়ন করাও প্রায় অসম্ভব।

সাবহানাজ রশিদ দিয়া আরও বলেন, ৬৬ ধারায় মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে যে বিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাক্‌স্বাধীনতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বিষয়টিই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করবে।

বিদ্যমান আইনের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত বিধান হলো, টেলিযোগাযোগ অর্থাৎ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ ও সরকারি সংস্থাগুলোর আড়ি পাতার অবাধ ক্ষমতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই দুটি বিধান বাতিল বা সংশোধনের প্রসঙ্গ জোরেশোরে আলোচনায় আসে।

টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন ও পরিমার্জনের বিষয়ে বিটিআরসিকে মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নির্দেশনাতেও এই বিধানের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ আছে।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেউ যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ সংশোধন ও পরিমার্জন করতে হবে। আইনের খসড়ায় আড়ি পাতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান নিয়ে আসতে বলা হয়। পাশাপাশি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) প্রশ্নে ‘বৈধতার প্রশ্ন তৈরি করার’ কথাও উল্লেখ করা হয়।

বিটিআরসির প্রস্তাবে টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধের বিধানসংশ্লিষ্ট ধারাটি বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রস্তাবে আড়ি পাতার বিষয়টি আগের মতোই রয়েছে।

প্রস্তাবের সঙ্গে বিটিআরসি মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনগতভাবে আড়ি পাতার বিষয়টি নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংশ্লিষ্ট। তাই বিদ্যমান আইনের ধারা ৯৭ক অংশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী পুনর্গঠন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ–সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে আড়ি পাতার ক্ষেত্র, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থার দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কর্মপদ্ধতির সুস্পষ্ট বিধান সংযোজনের প্রস্তাব করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশিদ দিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সংস্থার গবেষণায় আড়ি পাতার ধারার অসামঞ্জস্যতা ও অতিরিক্ত প্রয়োগের প্রমাণ মিলেছে। ধারার বিষয়টি শুধু স্বরাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ বিষয়টি নির্ধারণে নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, বেসরকারি খাতসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সময় নিয়ে পরামর্শ করা দরকার।