নগরজীবনের ক্রমবর্ধমান চাপ, জমির সংকট এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আবাসন খাত আজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। এমন প্রেক্ষাপটে নিরাপদ, টেকসই ও পরিবারকেন্দ্রিক আবাসনের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ফ্ল্যাট ও প্লট—দুই ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপের দর্শন, বর্তমান বাজারের চ্যালেঞ্জ, নতুন প্রজন্মের চাহিদা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রমজানুল হক নিহাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুল হক মো. মিরাজ।
ফ্ল্যাট ও প্লট—এই দুই ধরনের আবাসন ব্যবসায় আপনারা মূলত কী দর্শন অনুসরণ করেন? ক্রেতাদের দীর্ঘমেয়াদি আস্থার জায়গা কীভাবে নিশ্চিত হয়?
মো. রমজানুল হক নিহাদ: আমাদের মূল লক্ষ্য হলো সবার জন্য নিরাপদ ও টেকসই আবাসন নিশ্চিত করা। তবে বর্তমান বাস্তবতায় এটি আগের তুলনায় বেশি চ্যালেঞ্জিং। শহরের জমি সীমিত। যেখানে উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানেই দাম ও চাহিদা বাড়ছে। মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু নতুন জমি তৈরি হচ্ছে না। ফলে ক্রেতারা এখন শুধু লোকেশন বা দামের দিকে নজর রাখেন না; দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব ও নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্ল্যাট বা প্লট কেনা আজ একটি বড় বিনিয়োগ। নির্মাণাধীন প্রকল্পে ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন, আবার রেডি প্রকল্প তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। এই বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা প্রতিটি প্রকল্প এমনভাবে পরিকল্পনা করি, যেখানে ঝুঁকি কমানো ও সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা অগ্রাধিকার পায়।
প্রকল্পের শুরু থেকেই আমরা কিস্তিতে কেনার সুযোগ রাখি, যাতে ক্রেতারা ধাপে ধাপে বিনিয়োগ করতে পারেন। পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পের আগে বিস্তারিত মার্কেট স্টাডি করা হয়, যেন ক্রেতারা শুধু বাসস্থানের সুবিধাই না পান, ভবিষ্যতের বিনিয়োগেও সঠিক রিটার্ন নিশ্চিত হয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বল্পমেয়াদি নয়। আমরা পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে কাজ করি। রিয়েল এস্টেট আমাদের কাছে এক দিনের ব্যবসা নয়; এটি বিশ্বাস, দায়বদ্ধতা এবং সময়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা একটি সম্পর্ক। এই বিশ্বাসই ক্রেতাদের দীর্ঘমেয়াদি আস্থার সবচেয়ে শক্ত ভিত্তি।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় আবাসন খাতকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। নিরাপদ আবাসনে আস্থা অর্জনে আপনারা কোন কোন বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন?
মো. রমজানুল হক নিহাদ: ভূমিকম্প আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে—নিরাপদ আবাসন মানে শুধু চারদেয়াল নয়; এটি মানুষের বিশ্বাস, নিরাপত্তা ও মানসিক নিশ্চয়তার প্রতীক। বাংলাদেশে বড় মাপের ভূমিকম্প কম হয়, তবে ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও ক্ষতির ঘটনা ঘটে—প্রধানত নির্মাণে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে।
বর্তমান বাজারে আমরা দেখি, অনেক মানুষ আবাসনে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। নকশা অনুযায়ী কাজ না করা বা নিয়মিত তদারকি না থাকলে ভবনের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমরা নির্মাণের শুরু থেকেই সরকারি বিল্ডিং কোড অনুসরণ করি, যথাযথ ভিত্তি নির্মাণ করি এবং প্রতিটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করি। নির্মাণ চলাকালে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়। গুণগত মানই দামের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন নিরাপদ করে এবং আবাসন খাতে বিনিয়োগকে দীর্ঘ মেয়াদে সুরক্ষিত রাখে।
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আবাসন খাত কোন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে? উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?
মো. রমজানুল হক নিহাদ: নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি, অর্থায়নের সংকট এবং ক্রেতাদের সিদ্ধান্তহীনতা—এই তিন বিষয় বর্তমানে এ খাতের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আবাসন মানুষের মৌলিক চাহিদার অংশ। তাই নীতিগতভাবে এ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলে এটি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সরকার ইতিমধ্যে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন সেলস পারমিশন প্রক্রিয়া সহজ করা এবং ড্যাপ সংশোধনের মাধ্যমে ভবনের উচ্চতাসংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন।
তবে এসব উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে আবাসন খাতের জন্য আলাদা ফান্ডিং ব্যবস্থা বা সহজ শর্তে অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হলে ডেভেলপাররা কস্ট অব ফান্ড কমাতে পারবেন এবং ক্রেতারা তাঁদের চাহিদামতো জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। এতে নির্মাণ ব্যয় ও বাজারের দামের চাপ—দুটিই কমানো সম্ভব।
মধ্যবিত্ত ও নতুন প্রজন্মের ক্রেতাদের চাহিদা কীভাবে বদলাচ্ছে? সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকল্প পরিকল্পনা করছেন কীভাবে?
মো. রমজানুল হক নিহাদ: মধ্যবিত্ত ও নতুন প্রজন্মের ক্রেতারা আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন ও বাস্তবমুখী। তাঁরা শুধু দাম বা লোকেশন নয়, জীবনযাপনের মান ও দৈনন্দিন সুবিধা বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
নতুন প্রজন্ম বড় আকারের ফ্ল্যাট বা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার বদলে ব্যবহারযোগ্য স্পেস, পরিবারকেন্দ্রিক সুবিধা এবং সুস্থ জীবনযাপনের পরিবেশ চায়। তারা চাইছে, দৈনন্দিন ছোট সুবিধার জন্য বাড়ির বাইরে বা দূরে না যেতে। তাই প্রকল্পের মধ্যেই জগিং ট্র্যাক, জিমনেসিয়াম, খোলা জায়গা, গার্ডেন ও শিশুদের খেলার স্থান অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া কমিউনিটি স্পেস, বারবিকিউ কর্নার ও ছোট ওপেন স্পেসের গুরুত্ব বেড়েছে।
আমাদের প্রকল্প ডিজাইন মানে শুধু ফ্ল্যাট তৈরি নয়; বরং একটি পরিপূর্ণ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা। আধুনিক আবাসন এখন কেবল থাকার জায়গা নয়, এটি নিরাপদ, আনন্দময় ও ব্যবহারযোগ্য জীবনযাপনের প্রতীক।
আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপের ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা কী?
মো. রমজানুল হক নিহাদ: আমরা ভবিষ্যতে বড় গেটেড কমিউনিটি প্রকল্প আনার পরিকল্পনা করছি। সেখানে থাকবে সুপারশপ, লন্ড্রি সুবিধা, কমিউনিটি হল, জগিং ট্র্যাক, সাইকেল লেন, সুইমিংপুল ও ছাদবাগানের জন্য আলাদা জায়গা।
আমাদের লক্ষ্য কেবল ফ্ল্যাট বা প্লট বিক্রি করা নয়; বরং একটি নিরাপদ, আনন্দময় ও টেকসই ঠিকানা তৈরি করা—যেখানে ক্রেতারা নিজের পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পারবেন।