
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের উদ্যোগ তেমন কাজ দিচ্ছে না। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মাধ্যমে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের কথা চিন্তা করছে সরকার। তবে এ ক্ষেত্রেও জটিলতা রয়েছে সুদের হার নিয়ে। কারণ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এনজিওগুলোর সুদের হার দ্বিগুণের বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সিএমএসএমই খাতে দ্রুত ঋণ দেওয়ার সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ে সচিবালয়ে গত রোববার জুম প্লাটফর্মে একটি বৈঠক হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এমআরএ), পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনসহ (পিকেএসএফ) বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশ নেন।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অরিজিৎ চৌধুরী গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুদের হারসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার (আজ) আরেকটি বৈঠক হবে। সেখানেই সব চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
সুদের হার নিয়ে যে আলোচনাটা হয়েছে, তাতে গ্রাহক ৪ শতাংশ আর সরকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বহন করবে। এতে আমাদের কষ্ট হবে।হোসনে আরা বেগম, নির্বাহী পরিচালক, টিএমএসএস
করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ২১টি খাতে যে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা থেকে সিএমএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে দেওয়ার কথা। এ টাকা যথাযথ জায়গায় যাচ্ছে না বলেই নতুন নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানান আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা।
তিন বছর মেয়াদি প্রণোদনা প্যাকেজটির আওতায় সুদের হার ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রাহকেরা দেবেন মাত্র ৪ শতাংশ, যা সরাসরি পাবে ব্যাংক। বাকি ৫ শতাংশ সরকার ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি আকারে দেবে। অর্থাৎ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদই পাবে।
চলতি মূলধন ঋণ দেওয়া শুরু হয়েছে গত ১৩ এপ্রিল। কিন্তু আট মাস পার হলেও প্যাকেজটির বাস্তবায়নে অগ্রগতি কম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ জানায়, ৫৬টি ব্যাংক ও ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিএমএসএমই খাতের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে জড়িত। গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৭৬টি প্রতিষ্ঠান মোট ৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে, যা এই প্যাকেজের ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর ১০ ডিসেম্বর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্যাকেজের ঋণ বিতরণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, যা ৪৫ শতাংশের কম। ঋণ যাতে ভালোভাবে যায়, সে জন্য সরকারের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকার একটি আবর্তনশীল পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি গঠন করেছে।
সিএমএসএমই খাতের ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনীহ কেন, এমন প্রশ্নের জবাব জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) সঙ্গে কথা বলা হয়। কিন্তু ব্যর্থতার দায় মাথায় নিতে হচ্ছে বলে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
একটি ব্যাংকের এমডি জানান, সিএমএসএমই খাতে এত অল্প সুদে ঋণ দেওয়া যায় না। এতে ব্যাংকের পোষায় না। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রে ঘাটতি থাকে এবং তাদের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নেই বলেও ঋণ দেওয়া হয় না। এদিকে এনজিওগুলোর দেওয়া ঋণের সুদ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠানভেদে অবশ্য তা ১৫ থেকে ২০ শতাংশও আছে। সে জন্য সিএমএসএমই খাতে এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হলে সুদের হার কত দাঁড়াবে, তা নিয়ে কথা উঠেছে।
এরই মধ্যে সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল চেয়েছে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (এমআরএ)। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ১ শতাংশ সুদে ১০ হাজার কোটি টাকা দেবে। এ তহবিল থেকে সংস্থাটি থেকে সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো পরে গ্রাহকদের ঋণ দেবে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদে।
এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিকল্প পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, এনজিওগুলোর মাধ্যমে সুদহার হতে পারে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রাহক দেবে ৭ শতাংশ আর সরকার বহন করবে ৫ শতাংশ। এনজিওগুলোর প্রশাসনিক ব্যয়ের বিষয়ে অবশ্য কোনো পরামর্শ পায়নি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
যোগাযোগ করলে বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিএমএসএমইর জন্য কাজ করতে আমরা আগ্রহী। সুদের হার নিয়ে যে আলোচনাটা হয়েছে, তাতে গ্রাহক ৪ শতাংশ আর সরকার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বহন করবে। এতে আমাদের কষ্ট হবে। তবে সরকারের উদ্যাগটির সঙ্গে আমরা থাকব।’