ব্যালট বাক্স
ব্যালট বাক্স

ঋণখেলাপি প্রার্থীদের ভাগ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে

ঋণ পরিশোধ না করেও উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পথে হাঁটছেন অনেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তালিকায় তারা ‘খেলাপি’ হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও তাঁদের সরাসরি খেলাপি ঘোষণা করা যাচ্ছে না। কারণ, তাঁরা খেলাপি বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রার্থীদের ঋণের বর্তমান অবস্থা ও আদালতের আদেশের বিষয়টিও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে লেখা থাকবে, ঋণটি নিয়মিত। আদালতের আদেশে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খেলাপি ঘোষণায় স্থগিতাদেশ থাকবে। ফলে তাঁদের বিষয়ে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে অনেকের ঋণ পুনঃ তফসিল করা সম্ভব হয়নি। এখন নির্বাচনের আগে এ রকম অনেকেই আইনি বৈধতা পেতে আদালতের আশ্রয় নিচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে নির্বাচনের আগে খেলাপি প্রার্থীকেও ভালো হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে এবার সেই সুযোগ বন্ধ। যাঁরা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছেন, তাঁদের রিপোর্টে আদালতের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। আদালত থেকে সুরক্ষা পাওয়া নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। তাই এ নিয়ে আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু করণীয় নেই।’

আমরা প্রার্থীদের ঋণের যে অবস্থান তা-ই জানিয়ে দেব। কোনো সিদ্ধান্ত আমরা দেব না। যাঁরা রিট করে খেলাপিমুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আদালতের আদেশটিও প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
—আরিফ হোসেন খান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র, বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের অনেকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ও নীতিমালা শিথিল করে তাঁদের ঋণ নিয়মিত করেছে। এরপরও অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়মিত করতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন। ফলে তাঁরা ঋণ খেলাপি হওয়া–সংক্রান্ত আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ পেতে আদালতের আশ্রয় নেন। এতে অনেকে নিজের পক্ষে রায় পান। যেমন বিএনপি মনোনীত চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও চট্টগ্রাম নগরের আংশিক) আসনের প্রার্থী মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী ও কুমিল্লা ৬ আসনের প্রার্থী মনিরুল হক চৌধুরী আদালত থেকে এ ধরনের স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।

মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী রাইজিং গ্রুপের কর্ণধার। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে তাঁর গ্রুপের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। গত সরকারের সময় মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। তখন তাঁর ব্যবসা–বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়ে। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। এদিকে মনিরুল হক চৌধুরীর খেলাপি ঋণের বিষয়ে স্থগিতাদেশ থাকলেও তিনি ইতিমধ্যে পুরো ঋণ শোধ করেছেন। সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে তিনি ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা শোধ করেছেন। এ ছাড়া বিএনপির আরও এক ডজন প্রার্থী ঋণের বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রার্থীদের ঋণের যে অবস্থান তা–ই জানিয়ে দেব। কোনো সিদ্ধান্ত আমরা দেব না। যাঁরা রিট করে খেলাপিমুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আদালতের আদেশটিও প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঋণখেলাপি–সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তথ্য গোপন করে কোনো ঋণখেলাপি যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য মনোনয়নপত্র চূড়ান্ত করার আগে পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও রাত ১০টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) কার্যক্রম চলছে। আগামী ৪ জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে কর্মকর্তাদের। এবার প্রায় ৩ হাজার প্রার্থীর ঋণের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতি আছে। পাশাপাশি নির্বাচনে যাচাই–বাছাইয়ের সময় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থীর কাছে টাকা পাওয়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়ে মতামত দিতে পারবেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। এবারের সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরও যদি কারও ঋণখেলাপি হওয়া বা অন্য কোনো মিথ্যা তথ্য দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনে প্রার্থীদের বিষয়ে ব্যাংকগুলো যেন প্রকৃত তথ্য দেয়, সে বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, তথ্য গোপন না করে, এমনকি কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর ‘আনরিপোর্টেড’ বা ‘গোপন ঋণ’ থাকলে তা সিআইবি ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অহেতুক কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়, সে নির্দেশনা দিয়ে গভর্নর বলেন, ক্রেডিট কার্ড বা অন্য কোনো ফি পরিশোধ না করার কারণেও কাউকে খেলাপি দেখানো যাবে না।

তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এরই মধ্যে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শুরু করেছেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গতকাল সোমবার। আজ ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বাছাই। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা যাবে ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি। আপিল নিষ্পত্তি হবে ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ জানুয়ারি।