মেঘনা নদী থেকে পানি উত্তোলন করে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এনএসইজেড)’ সরবরাহের জন্য তিন বছর আগে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পানির চাহিদা নিরূপণ ও দাম নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজই এখনো শেষ হয়নি। শুরু হয়নি নির্মাণকাজও। অথচ পানির চাহিদা বাড়ছে ওই শিল্পাঞ্চলে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে নেওয়া প্রকল্পটি নীতিগত অনুমোদন পায় ২০২২ সালের আগস্টে। পরের বছর শুরু হয় সম্ভাব্যতা যাচাই। চার মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে এখন ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পিপিপি কর্তৃপক্ষ বা পিপিপিএ, কোরীয় ঋণদাতা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও পানির দাম চূড়ান্ত হয়নি। চাহিদা কতটুকু হবে, সেটিও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত ২৫ জুনও এ নিয়ে বৈঠক হয়। যদিও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ১ হাজার লিটার পানির দাম ৯১ টাকা প্রস্তাব করলেও অন্যান্য খরচ মিলে তা প্রায় ১২০ টাকা পর্যন্ত দাঁড়াবে। এ দামে পানি কিনতে অনীহা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
এনএসইজেডে ২০ একর জায়গার ওপর শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছে মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক সফল বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় প্রতি ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৫০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বেজা ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রতি এক হাজার লিটার পানি ব্যবহারে গড়ে ৩২ টাকা খরচ হচ্ছে। তবে এর বেশি দামে পানি কিনলে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে।’
এনএসইজেডে পানি সরবরাহ প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, প্রথম ধাপে দৈনিক ২৫ কোটি ও দ্বিতীয় ধাপে আরও ২৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবনায়। প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এবং প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের মধ্যে। দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হওয়ার কথা ২০২৮ সালের জানুয়ারিতে, শেষ হওয়ার কথা ২০৩১ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষও হওয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রকল্পটির সরকারি ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ব্যয় ৮ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। সরকারি অর্থে জমি অধিগ্রহণ, নদী শাসন ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় হবে এবং বেসরকারি অর্থে শোধনাগার ও পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। বেসরকারি অংশীদার হিসেবে রয়েছে কোরিয়া ওভারসিজ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হলো কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংক।
প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে পিপিপির প্রধান নির্বাহী মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা ও দাম নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে না। বিষয়গুলো চূড়ান্ত হওয়ার পর ওয়াসা ও বেজার মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই কাজ শুরু হবে।
বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা সন্দ্বীপ চ্যানেলের পাশে গড়ে তোলা হচ্ছে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বেজার মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা ঘিরে গড়ে ওঠা এনএসইজেডের আয়তন শুরুতে ছিল ৩৩ হাজার ৮০৫ একর। তবে এ আয়তন কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজা। তারা প্রথম দফায় ৭ হাজার একর, দ্বিতীয় দফায় ১০ হাজার একর ও তৃতীয় দফায় ৪ হাজার একর আয়তন নির্ধারণ করেছে, অর্থাৎ মোট ২১ হাজার একর জায়গায় গড়ে উঠবে বিভিন্ন স্থাপনা।
বেজা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নামে এ শিল্পনগরের উদ্বোধন করা হয়। সেখানে জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিলে আবেদন নেওয়া শুরু করে বেজা। বর্তমানে ১৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনে রয়েছে। আরও ২৭টি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলছে।
বেজা জানিয়েছে, বর্তমানে ৪০টি গভীর নলকূপ থেকে পানি নিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন পানির চাহিদা দিনে মাত্র ১০ লাখ লিটার। তবে দিন দিন পানির চাহিদা বাড়ছে। আগামী বছর পানির চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে দিনে ৩ কোটি লিটার। ২০২৭ সালে ৫ কোটি লিটার, ২০২৮ সালে ৭ কোটি লিটার আর ২০২৯ সালে ১০ কোটি লিটার। যদিও চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ১০ বা ২০ বছর পর পানির চাহিদা আদতে কত হবে, সেটি এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। এ নিয়ে কাজ চলছে।
তবে পানির সংকট কাটাতে আপাতত প্রায় ৬৩২ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বেজা। ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। ব্যয় ১২৯ কোটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬১ কোটি টাকায়। আগামী বছরের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ শেষ হলে মুহুরী জলাধার থেকে আসবে দৈনিক পাঁচ কোটি লিটার।
পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত পানির সংকট হবে না। তবে এরপর নতুন কারখানাগুলো উৎপাদনে গেলে চাহিদা বাড়বে। তখন মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ প্রকল্প কার্যকর হবে।