সাড়ে তিন দশক আগে কোটাসুবিধায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রথম পোশাক রপ্তানি করেছিলেন এশিয়ান গ্রুপের তখনকার তরুণ উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবদুস সালাম। ২০০৫ সালে ১ জানুয়ারি কোটাপ্রথা উঠে গেলেও ক্রেতারা ছেড়ে যাননি তাঁকে; বরং মার্কিন ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে পোশাকের নতুন নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন তিনি। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে গ্রুপটির ১৩ কারখানার ৭টিই শতভাগ পোশাক রপ্তানি করেছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে। সব মিলিয়ে এশিয়ান গ্রুপের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশই রপ্তানি হচ্ছে বড় এই বাজারে।
আবদুস সালামের মতো চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। এই অতিনির্ভরতাকে এখন ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন তাঁরা। কারণ, আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। পাল্টা শুল্কের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো দর–কষাকষি চলছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শুল্কহার বেশি হলে বিপদে পড়ার শঙ্কা দেখছেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানির ১৯ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছরে দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। আবার চট্টগ্রামের মোট পোশাক প্রতিষ্ঠানের ৭০ শতাংশই নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে, সারা দেশে এই হার ৪৯ শতাংশ।
আশি–নব্বই দশকে ঢাকার কারখানাগুলো শুধু কোটার ওপর নির্ভরশীল ছিল না, অন্য দেশের ক্রেতাদের কার্যাদেশ পাওয়ার সুযোগ ছিল। চট্টগ্রামের সে সুযোগ কম থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে—মোহাম্মদ আবদুস সালাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এশিয়ান গ্রুপ
চট্টগ্রাম থেকে কেন শতাংশের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেশি, জানতে চাইলে এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, আশি–নব্বই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোটাসুবিধা নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন। যোগাযোগব্যবস্থাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে সে সময় অন্য দেশের ক্রেতারা আসতে চাইতেন না। ফলে ঢাকার কারখানাগুলো শুধু কোটার ওপর নির্ভরশীল ছিল না, অন্য দেশের ক্রেতাদের কার্যাদেশ পাওয়ার সুযোগ ছিল। চট্টগ্রামের সে সুযোগ কম থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
আশি–নব্বই দশকের চট্টগ্রামের রপ্তানির পরিসংখ্যান আলাদা করে পাওয়া যায়নি। তবে দুই দশক আগে ২০০৫–০৬ অর্থবছরের তথ্য থেকে পোশাক খাতের শীর্ষ পর্যায়ের উদ্যোক্তা আবদুস সালামের কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময় পণ্য রপ্তানি হওয়া চট্টগ্রাম কাস্টমস, শাহজালাল বিমানবন্দর, কমলাপুর কাস্টমস ও বেনাপোল কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, সে সময় সারা দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৩৩ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে চট্টগ্রামের মোট পোশাক রপ্তানির ৬৩ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দুই দশকের ব্যবধানে এখন এই হার কিছুটা কমলেও এখনো জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নানা প্রকাশনা থেকে জানা যায়, আশির দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পোশাক নেওয়ার জন্য কোটা বরাদ্দ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র; অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কত পরিমাণ পোশাকের ক্রয়াদেশ দেওয়া হবে, তা এই কোটার মাধ্যমে বরাদ্দ করা হতো। ১৯৭৪ সালে কার্যকর হওয়া মাল্টিফাইবার চুক্তির (১৯৭৪–৯৪) আওতায় এই কোটা পেত বাংলাদেশও।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে, কোনো কারখানার একক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই চট্টগ্রামের রপ্তানিকারকদের বাজার বৈচিত্র্যকরণে নজর দেওয়া দরকার—মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
১৯৯৪ সালে মাল্টিফাইবার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে আবারও কোটাসুবিধা বহাল করা হয়। ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘দ্য অ্যাগ্রিমেন্ট অব টেক্সটাইল ও ক্লথিংয়ের (এটিসি)’ আওতায় কোটা চালু হয়। এই কোটা বহাল ছিল ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পোশাকে কোটাব্যবস্থা উঠে যায়।
বাংলাদেশে প্রথম রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার দেশ গার্মেন্টসের যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে, ১৯৭৮ সালে। দেশ গার্মেন্টসের দেখানো পথ ধরে চট্টগ্রামে দ্রুত বিকশিত হতে শুরু করে এই শিল্প। সে সময় কোটাসুবিধার কারণে খুব সহজে ক্রয়াদেশ পেয়ে যেতেন উদ্যোক্তারা।
বিজিএমইএর হিসাবে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রায় ৪০০ নতুন তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছিল, যাদের বেশির ভাগের রপ্তানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে।
এ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কোটাসুবিধার মেয়াদ শেষের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপি পায় বাংলাদেশ। এই সুবিধা প্রথম পুরোপুরি নিতে শুরু করেন ঢাকা অঞ্চলের উদ্যোক্তারা। ইউরোপীয় ক্রেতারাও চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকায় আসা–যাওয়ায় স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। কারণ, চট্টগ্রামে ভালো মানের হোটেল ছিল না। যাতায়াত এখনকার মতো সহজ ছিল না। আবার কারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা অনুমোদন ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। ব্যাংকিং–সুবিধা ছিল চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকায় বেশি। এতে ঢাকা অঞ্চলে তৈরি পোশাক খাত বিকশিত হতে শুরু করে। চট্টগ্রামে নতুন কারখানার প্রবৃদ্ধি কমে যায়। যেমন বিজিএমইএর হিসাবে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে বছরে গড়ে ৪০টি কারখানা স্থাপিত হয়। আর ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ১০ বছরে গড়ে তা ১৭টিতে নেমে আসে। নতুন নতুন কারখানার সংখ্যা কমে আসায় পুরোনো উদ্যোক্তারাই এই খাতে এগিয়ে রয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগের বাজার যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর।
প্রায় ৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে চট্টগ্রামের ক্লিফটন গ্রুপ। গ্রুপটির যাত্রা শুরুর প্রথম দুই দশকে একচেটিয়া রপ্তানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। কিছুটা বৈচিত্র্য আনলেও এখনো বেশির ভাগ পোশাক রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।
জানতে চাইলে ক্লিফটন গ্রুপের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম ডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামে উদ্যোক্তাদের হাতেখড়ি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশও ছিল বেশি। সে সময় হাতে ব্যবসা থাকায় নতুন বাজার খুঁজতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখানকার উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক গড়িয়েছে দুই–তিন দশক পর্যন্ত। বড় বাজারটির ওপর অতিনির্ভরতার এটিই বড় কারণ।
কোনো একক বাজারের ওপর অতিনির্ভরতাকে ব্যবসার জন্য ঝুঁকি মনে করছেন গবেষকেরা। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে, কোনো কারখানার একক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই চট্টগ্রামের পোশাক রপ্তানিকারকদের এখন বাজার বৈচিত্র্যকরণে নজর দেওয়া দরকার।