
চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় রিফ লেদার নামের ট্যানারি দীর্ঘদিন ক্রয়াদেশ–সংকটে ভুগছিল। চামড়ার দামও ছিল কম। পরে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পায় প্রতিষ্ঠানটি। তারপর থেকে নতুন নতুন ক্রেতা পেতে শুরু করে রিফ লেদার। ধীরে ধীরে ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে তাদের।
টি কে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিফ লেদারের মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৬ লাখ বর্গমিটার চামড়া। বর্তমানে মাসে ৪ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ চামড়া রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ভারত, অস্ট্রেলিয়া, চীন ও হংকংয়ের ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান রিফ লেদার থেকে নিয়মিত ফিনিশড বা প্রস্তুত চামড়া কেনে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি এলডব্লিউজি সনদ পায়।
জানতে চাইলে রিফ লেদারের পরিচালক মো. মোকলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার পর আমাদের চামড়া কিনতে নতুন নতুন ক্রেতা আসছে। তবে আগে বিদেশি ক্রেতারা একসঙ্গে অনেক চামড়া কিনলেও বর্তমানে কম কিনছে। সে জন্য রপ্তানি প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব ট্যানারি গড়ে তোলার পর আমাদের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের ব্যবহার কমেছে। আমরা সাধারণ ট্যানারির চেয়ে চামড়ার বেশি দাম পাচ্ছি।’
রিফ লেদারসহ দেশের মাত্র আট প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। যদিও সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরকে গত ২২ বছরে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি সরকার। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। তাই পরিবেশদূষণের কারণে এই শিল্পনগরের ১৪২ ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদন করতে পারছে না।
২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য।
এলডব্লিউজির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ হাজার ৪৫৫টি চামড়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সনদ পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩৫টি প্রতিষ্ঠান ইতালির। এ ছাড়া চীনের ২০৪, ভারতের ১৯৬, ব্রাজিলের ৯৮, পাকিস্তানের ৪৬, ভিয়েতনামের ২৪ ও থাইল্যান্ডে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে।
এলডব্লিউজি বনাম সাধারণ ট্যানারি
বাংলাদেশে প্রথম এলডব্লিউজি সনদ পায় অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ট্যানারি ইউনিট, ২০১৫ সালে। তারা নিরীক্ষায় সেরা মান, অর্থাৎ গোল্ড কারখানার মর্যাদা পেয়েছে। অ্যাপেক্স ওয়েট ব্লু নয়, চামড়া প্রক্রিয়াকরণের দ্বিতীয় ধাপ ‘ক্রাস্ট’ ও তৃতীয় ধাপ ‘ফিনিশড’ পর্যায়ে কাজ করে। পরে রিফ লেদার, অস্টান লিমিটেড, এবিসি লেদার, সুপারেক্স লেদার, এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, পাইওনিয়ার সিমোনা ট্যানিং এবং সং শিন লেদার এলডব্লিউজি সনদ পায়।
খুলনার ফুলতলার উত্তর ডিহিতে ২০১৬ সালে সুপারেক্স লেদার নামে ট্যানারি গড়ে তোলেন উদ্যোক্তা ফিরোজ আহমেদ। পরের বছর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। শুরুতে ভালো ক্রয়াদেশ পেলেও পরে ইউরোপের ক্রেতারা জানিয়ে দেন, এলডব্লিউজি সনদ না থাকলে চামড়া কিনবে না। তখন ফিরোজ আহমেদ পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ট্যানারিতে বিনিয়োগ করেন। ২০২৩ সালে এলডব্লিউজি সনদ পায় সুপারেক্স লেদার।
খুলনার এই ট্যানারিতে দৈনিক এক লাখ বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে মাসে ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করে। ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, তাইওয়ান, জাপানের ৮-১০টি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান সুপারেক্স থেকে চামড়া কিনছে।
জানতে চাইলে সুপারেক্স লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিযোগী দেশগুলোয় অনেকগুলো করে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া ট্যানারি রয়েছে। তাই বাংলাদেশে ক্রেতা কম আসছে। সাধারণ ট্যানারি থেকে আমরা কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকলেও দেশে যদি আরও এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া ট্যানারি থাকে তাহলে ক্রেতারা বেশি আসত।’
ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর চামড়াপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৪৯৮ বিলিয়ন বা ৪৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের। চলতি বছর শেষে সেটি বেড়ে ৫৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
চামড়া খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানিতে ভালো করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ লাগবে। এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া ট্যানারিগুলো তুলনামূলক ভালো ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। সাধারণ ট্যানারিগুলো প্রতি বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করছে ৯০ সেন্টে। আর এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া ট্যানারি ২ ডলার পর্যন্ত দাম পাচ্ছে।
বিশাল বৈশ্বিক বাজার থাকলেও দেশের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি বাড়ছে না। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াপণ্যের রপ্তানি ছিল ১১৬ কোটি মার্কিন ডলারের। আর গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১১৫ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য।
জানতে চাইলে চামড়া পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি মো. নাসির খান প্রথম আলোকে বলেন, এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া আটটি ট্যানারি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। সে জন্য ট্যানারিগুলো বিদেশি ক্রেতাদের খুব বেশি টানতে পারছে না। সাভারের চামড়াশিল্প নগরের ১৪২ ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদ পেলে ক্রেতারা আস্থা পাবেন। সে জন্য সাভারের চামড়াশিল্প নগরকে পরিবেশবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ দরকার।