
বড়াল নদের ঠিক পাড়েই কালুহাটি গ্রাম। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার এই গ্রামে ঢুকতেই এখানে-ওখানে চোখে পড়ে বিভিন্ন পাদুকা কোম্পানির নানা বিজ্ঞাপন। গ্রামের একটু ভেতরে গেলেই বাড়িতে বাড়িতে জুতার কারখানার সাইনবোর্ড দেখা যায়। তবে ব্যবসা এখন আর আগের মতো জমজমাট নেই।
ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা জানান, অতীতে এই গ্রামে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা হতো। করোনার সময় থেকেই ব্যবসায়ে ভাটা পড়েছে, কারখানাও কমেছে। এমনকি ঈদেও বিভিন্ন জায়গার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা তেমন আসেননি। চলতি বছর মোট ১০ কোটি টাকারও ব্যবসা হবে কি না সন্দেহ।
করোনার আগপর্যন্ত জুতার ৭৫টি কারখানা ছিল গ্রামটিতে। এখন আছে ৫০টির মতো। এর মধ্যে আবার কিছু কারখানা চালু থাকলেও সেগুলোর শ্রমিকসংখ্যা ও উৎপাদন কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
কারখানা মালিকেরা বলছেন, কালুহাটি গ্রামে তৈরি জুতা রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার পাইকারেরা এসে নিয়ে যান। তবে এখন আর আগের মতো নেন না। কারণ, দেশে বর্তমানে অত্যাধুনিক মেশিনে জুতা তৈরি করা হয়, তাতে খরচও কম। এ ছাড়া ভারত ও চীনের জুতায় বাজার সয়লাব হয়ে আছে। সেগুলোর দামও কম। অন্যদিকে তাঁদের হাতে তৈরি জুতার উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে। তাই তাঁদের বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে তাঁরা বাজার হারাচ্ছেন।
জানা গেছে, করোনার আগপর্যন্ত জুতার ৭৫টি কারখানা ছিল গ্রামটিতে। এখন আছে ৫০টির মতো। এর মধ্যে আবার কিছু কারখানা চালু থাকলেও সেগুলোর শ্রমিকসংখ্যা ও উৎপাদন কমিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
কালুহাটি গ্রামের ‘রাজ সুজ’ নামের জুতার কারখানার মালিক মো. রাজীব আলী জানান, তিনি ২০১৪ সালে নিজের বাড়িতে জুতা তৈরির কারখানা খোলেন। একসময় এখানকার জুতা রাজশাহী বিভাগসহ উত্তরাঞ্চলের সর্বত্র পৌঁছে যেত। কিন্তু করোনার সময় থেকে আর আগের সেই অবস্থা নেই। এমনকি করোনার সময়ে জুতা বিক্রির টাকা এখনো অনেকে তুলতে পারেননি। তাঁরও ১০ লাখের বেশি পাওনা টাকা আটকে আছে পাইকারদের কাছে।
কালুহাটিতে প্রথম দিকে যাঁরা জুতার কারখানা দিয়েছেন বা কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে পেশা বদল করেছেন। যেমন নুরুল ইসলাম নামের একজন আগে কারখানার মালিক ছিলেন, এখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান।
‘মিঠু সুজ’-এর কারিগর রুমা আক্তার জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে জুতা তৈরির পেশায় আছেন। এই কাজ করেই দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বাড়িঘর বানিয়েছেন। রুমা বলেন, এই পেশায় আগে গ্রামের অনেক নারী কাজ করতেন। তাতে মানুষের সচ্ছলতা ফিরেছে। কিন্তু এখন জুতা বিক্রি কমে গেছে। সে জন্য কারখানা একে একে বন্ধ হচ্ছে। কোনো কোনো কারখানার মালিক তো ঋণগ্রস্ত হয়ে এলাকা ছেড়ে গেছেন।
বিজয় সুজ অ্যান্ড বার্মিজের মালিক সোহেল আহমেদ বলেন, আগে ঈদের সময় এলে কথা বলার সময় থাকত না। অথচ এখন একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা চিত্র। কোনো ক্রেতা নেই। আগে ১০ হাজার মানুষ জুতার কারখানাগুলোয় বিভিন্ন কাজ করলেও এখন অর্ধেকও নেই। তাঁরা এই পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছেন।
এম এস সুজের কারিগর মো. মোস্তাকিন বলেন, ‘আমার এই বয়সে এত ঢাল সিজন কখনো দেখিনি। দুই-তিন বছর আগেও জুতা কেনার জন্য ব্যবসায়ীরা ভিড় করতেন, শুয়ে-বসে অপেক্ষা করতেন। আমরা দিনরাত কাজ করিয়ে জুতা ডেলিভারি দিতাম। এখন ব্যবসায়ীরা তেমন আসেন না, উল্টো আমরাই জুতো নিয়ে শহরে দিয়ে আসি। এতে টাকা বাকি পড়ে থাকে।’
‘কোনোরকমে ধুঁকে ধুঁকে চলছে কারখানাগুলো। ঈদের সময়ও ক্রেতা নেই। অথচ আগে এই সময়ে ক্রেতার ভিড়ে দিনরাত কাজ করতে হতো।সোহেল রানা, সাধারণ সম্পাদক, কালুহাটি পাদুকা সমবায় সমিতির
১৯৮৫ সালে জুতার কারখানা শুরু করা জয়নাল আলী জানান, এই ব্যবসা একসময় তাঁর ভাগ্য বদলে দিয়েছিল। জায়গাজমি কিনেছিলেন, বাড়িঘর সব করেছিলেন। কিন্তু এখন শুধু লোকসানই হয়। তাই জুতার এক পাশে মুদিদোকান খোলার কথা ভাবছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮০ সালের দিকে কালুহাটি গ্রামের তরুণ কাসেম আলী প্রথম ঢাকায় গিয়ে জুতা তৈরির কাজ শেখেন। তিনি আরও কয়েকজনকে ঢাকায় নিয়ে যান। কাজ শিখে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন। তখন গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি আমজাদ হোসেনের অর্থায়নে রুবেল সুজ নামে একটি জুতার কারখানা স্থাপিত হয়। সেটির সফলতা দেখে নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। এ নিয়ে ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট ‘বদলে যাওয়া কালুহাটি’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। তখন এলাকার সংসদ সদস্য (বর্তমানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) মো. শাহরিয়ার আলমের মাধ্যমে এই গ্রামের জুতাশিল্প সম্পর্কে জানতে পারে এসএমই ফাউন্ডেশন। সে অনুযায়ী সরকারি সংস্থাটি নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
কালুহাটিতে প্রথম দিকে যাঁরা জুতার কারখানা দিয়েছেন বা কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদের অনেকেই ইতিমধ্যে পেশা বদল করেছেন। যেমন নুরুল ইসলাম নামের একজন আগে কারখানার মালিক ছিলেন, এখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান।
গ্রামের প্রথম কারিগর কাসেম আলী এখনো জুতা তৈরি করেন। পুঁজির অভাবে তিনি কোনো কারখানা করতে পারেননি। জরাজীর্ণ ঘরের বারান্দায় বসে দুই-এক জোড়া জুতা বানিয়ে বিক্রি করে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, জুতার কারখানা করে এলাকার অনেকেরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। ঘরবাড়ি, জায়গাজমি হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে তিনি নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেননি। তবে এখনো স্বপ্ন দেখেন তাঁর একটি বড় কারখানা হবে।
কাসেম আলীর ভাই ইসরাইল আলী শ্রাবণী সুজ নামে একটি কারখানা চালান। তিনি বলেন, অনেকে বলেন যে আধুনিক মেশিন এলে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু মেশিন এলে তো অনেক মানুষ কাজ হারাবেন। এভাবে যদি বাজার তৈরি করা যায়, সেটাও ভালো।
১৯৮০ সালের দিকে কালুহাটি গ্রামের তরুণ কাসেম আলী প্রথম ঢাকায় গিয়ে জুতা তৈরির কাজ শেখেন। তিনি আরও কয়েকজনকে ঢাকায় নিয়ে যান। কাজ শিখে তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন। তখন গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি আমজাদ হোসেনের অর্থায়নে রুবেল সুজ নামে একটি জুতার কারখানা স্থাপিত হয়। সেটির সফলতা দেখে নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
কালুহাটি পাদুকা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, ‘কোনোরকমে ধুঁকে ধুঁকে চলছে কারখানাগুলো। ঈদের সময়ও ক্রেতা নেই। অথচ আগে এই সময়ে ক্রেতার ভিড়ে দিনরাত কাজ করতে হতো। এমনকি করোনার সময়ও বাজার এতটা খারাপ ছিল না। করোনার আগে বছরে ৫০-৬০ কোটি টাকার জুতা বিক্রি হতো। করোনার পর থেকে আর বিক্রির হিসাব রাখা হয় না। এবার ব্যবসা ১০ কোটিও হবে কি না, সেই আশঙ্কায় আছি।’
সোহেল রানা জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সহায়তার ফলে তাঁরা জুতা তৈরির মেশিন, তথা যন্ত্রের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। ইতিমধ্যে ১১টি যন্ত্র বরাদ্দ হয়েছে। শিগগিরই এগুলো পাওয়া যাবে। তখন গ্রামের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে এসব যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। ফলে বাজারের অন্যান্য জুতার সঙ্গে কালুহাটি গ্রামের জুতা পাল্লা দিতে পারবে বলে সোহেল রানা আশা করেন।