মূল্যস্ফীতি 

অর্থের মান পড়ে গেলে কী হয়

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির যুগে দেশটির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এত খারাপ ছিল যে রাস্তায় কেবল ভিখারির দেখা মিলত। এরা পারলে একজন আরেকজনের মাথা কেটে ফেলত। এর কারণ আর কিছু নয়—মূল্যস্ফীতি। বিষয়টি হচ্ছে, ১৩০০ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় একই ছিল। কিন্তু ১৫০০ সালের পর পরিস্থিতি একদম ঘুরে যায়। 

পঞ্চদশ শতক থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ে পরিণত হয়, যেটা একসময় অচিন্তনীয় ছিল। ৫০ বছরের মধ্যে ইউরোপের গড় পণ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। ১৫৯০ সাল থেকে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার বার্ষিক ৩ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায়।

পরিসংখ্যানগত দিক থেকে এটি খুব বড় না হলেও আমাদের প্রাক্‌পুঁজিবাদী সেই সময়ের কথা মনে রাখতে হবে। তখন মানুষের আয় বৃদ্ধি বলে কিছু ছিল না। ফলে মূল্যস্ফীতির হার যা-ই হোক না কেন, তাতে মানুষ আরও গরিবই হতো। মূল্যস্ফীতির এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হয়। 

ব্ল্যাক ডেথের পর সেই সময় ইউরোপে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গতি পায়। শুরু হয় নগরায়ণ। এতে সমাজে খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, যদিও খাবার উৎপাদনকারী কৃষকজের সংখ্যা হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে রাজাদের মুদ্রা কারসাজির কারণেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা শুরু হয়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রাষ্ট্র দুর্বল হয় এবং ঋণসংকটে পড়ে। ১৫৪৪ ও ১৫৪৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি রাজস্ব বৃদ্ধি করতে ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করে দেন। এমনকি পরবর্তীকালে রানি প্রথম এলিজাবেথও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করেছেন।

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির সময় মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার কারণ ছিল বাছবিচারহীনভাবে মুদ্রা তৈরি। তখন একটি ধাতব মুদ্রা গলিয়ে তার সঙ্গে নানাবিধ ধাতু যোগ করে তাকে দুটি সোনার মুদ্রায় পরিণত করা হতো। এই পদ্ধতিতে রাজা হেনরি জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ সমপরিমাণ মুদ্রা বাজারে ছাড়তেন। অতিরিক্ত এই অর্থ হেনরি যুদ্ধ ও প্রাসাদ নির্মাণে ব্যয় করতেন। ফলে সমাজে যে চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তার কারণে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। শুধু হেনরি বা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড নন, ১৫৩৮ সাল থেকে স্কটল্যান্ড এই কাজ শুরু করে। ১৫৬০ সালের দিকে তারা এই হার দ্বিগুণ করে ফেলে। আজকের নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গে ১৫২১ থেকে ১৬৪৪ সালের মধ্যে রৌপ্য মুদ্রার অবনমন করা হয় ১২ বার। 

তবে শুধু মুদ্রার অবনমনের কারণেই যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগ শুরু হয়, তা নয়। ১২৮৫ থেকে ১৪৯০ সালের মধ্যে ফ্রান্স ১২৩ বার তার রৌপ্য মুদ্রার অবনমন করে। কিন্তু তখন মূল্যস্ফীতির হার বাড়েনি। এমনকি ১৫০০ সাল জুড়ে অনেক দেশ মুদ্রার অবনমনের হার হ্রাস করলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। ১৪৯৭ থেকে ১৬৮৬ সালের মধ্যে স্পেন মুদ্রার অবনমন একেবারেই বন্ধ করে দেয়। ফলে অনেক ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষক মনে করেন, নিছক চাহিদা বৃদ্ধির তত্ত্ব দিয়ে ইউরোপের এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা ব্যাখ্যা করা যায় না। এর পেছনে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর পারের ঘটনাপ্রবাহও দায়ী। 

বিষয়টি হলো, ১৫৪৫ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় রুপার খনি আবিষ্কৃত হয়। পোতোসি নামক যে শহরে এই খনি আবিষ্কৃত হয়, সেই শহর শিগগিরই বিশ্বের পঞ্চম খ্রিষ্টান অধ্যুষিত শহরে পরিণত হয়। এই খনি আবিষ্কারের আগে ইউরোপের উপকূলে সব মিলে মাত্র ১০ টন রুপা পাওয়া গেছে। তবে সেই শতকের তৃতীয় ভাগে দেখা গেল, ইউরোপে প্রায় ১৭৩ টন রুপার চালান এসেছে। প্রথমত, স্পেনে সেই চালান আসে। ফলে দেখা গেল, ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির শিকার হয় স্পেন। এরপর তা ইউরোপের অন্যান্য উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে—একদম রাশিয়া পর্যন্ত। 

১৫ ও ১৬ শতকে ইউরোপজুড়ে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফল হলো সামাজিক বিশৃঙ্খলা। যে ভূস্বামীরা জমির নির্ধারিত খাজনার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, চাপটা তাঁদের ওপরই পড়ল। তাঁদের পক্ষে রাতারাতি জমির খাজনা বাড়ানো সম্ভব হলো না। ১৫৬০-এর দশকে ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে অসমতা কমে এল। মধ্যম আয়ের মানুষের অবস্থার উন্নতি হলো। শুরু হলো ইউরোপজুড়ে খুনোখুনি ও সংঘাত। 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রাষ্ট্র দুর্বল হয় এবং ঋণসংকটে পড়ে। ১৫৪৪ ও ১৫৪৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি রাজস্ব বৃদ্ধি করতে ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করে দেন। এমনকি পরবর্তীকালে রানি প্রথম এলিজাবেথও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করেছেন। অর্থের বিনিময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নাইটহুড উপাধি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সরকারি ঋণ। ১৩০০ ও ১৪০০ শতকে ইউরোপে সরকারের ঋণখেলাপি হওয়া বিরল বিষয় হলেও ১৫৫৮, ১৬২৪ ও ১৬৪৮ সালে ফ্রান্স, ১৫৬০ সালে পর্তুগাল, ১৫৫৭, ১৫৭৫, ১৫৯৬, ১৬০৭, ১৬২৭ ও ১৬৪৭ সালে স্পেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারেনি। 

তবে একসময় উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই ধারা থিতিয়ে আসে। চাহিদাও কমে আসে। 

ইতিহাসের শিক্ষা হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে শুধু মানুষের জীবনমানের অবনতি হয় তা নয়, বরং রাষ্ট্রও বিপদে পড়ে। সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়।