সপ্তাহে কত দিন কাজ করা কর্মী ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্য ভালো—চার দিন, পাঁচ দিন নাকি ছয় দিন? এটা নিয়ে নানা মত রয়েছে। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান পাইলট প্রকল্প আকারে, আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে চার দিনের কর্মসপ্তাহ শুরু করেছে। কেউ এর পক্ষে, কেউ এর বিপক্ষে।
চার দিনের কর্মসপ্তাহ আসলে স্বপ্ন, বাস্তবতা নাকি অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি—এটা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক চলছে অস্ট্রেলিয়ায়। দেশটির অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস (এসিটিইউ) চার দিনের কর্মসপ্তাহ চালুর প্রস্তাব করার পর শুরু হয়েছে এই বিতর্ক। সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কমিয়েও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়, এমন ধারণা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও দ্বিমত রয়েছে দেশটির ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
কোভিড-১৯ মহামারির পর মানুষ সময়, কাজ ও সুস্থতাকে নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে। বৃদ্ধি পেয়েছে মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব। এসিটিইউ যুক্তি দিয়েছে যে কম সময় কাজ করা মানেই কম উৎপাদন নয়। বরং এটি কর্মদক্ষতা বাড়াতে পারে, মানসিক চাপ কমাতে পারে এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সুফল ন্যায্যভাবে বণ্টনে সহায়তা করতে পারে। এসিটিইউর সেক্রেটারি স্যালি ম্যাকম্যানাস ব্যাখ্যা করেন, ‘আমরা চাইনি যে সরকার হঠাৎ নতুন শ্রম আইন তৈরি করুক। আমরা শুধু একটি আলোচনার সূচনা করেছি, উৎপাদনশীলতার সুফল কীভাবে ভাগ বা বণ্টন করা উচিত, সে বিষয়ে।’
তবে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এটি মানতে নারাজ। দেশটির অস্ট্রেলিয়ান ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ইনেস উইলক্স প্রস্তাবটিকে খারিজ করে এ প্রস্তাবকে আরেকটি জনতুষ্টিবাদী, উৎপাদনবিরোধী চিন্তা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, অস্ট্রেলিয়া বর্তমান দুর্বল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির হারে চললে কাজের দিন কমাতে গেলে অর্থনীতিকে পিছিয়ে যাবে।
সরকারও এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ফেডারেল সরকারের ট্রেজারার জিম চ্যালমার্স স্পষ্ট করেছেন, চার দিনের কর্মসপ্তাহ লেবার সরকারের এজেন্ডায় নেই, যদিও তিনি ফ্লেক্সিবল ও হাইব্রিড কাজের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যা মহামারির পর বহু অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হিসেবে অনুভব করেছেন।
ইতিহাস বলছে, অস্ট্রেলীয়রা ধীরে ধীরে কম সময় কাজ করা ও বেশি ছুটি পাওয়ার সুবিধা ভোগ করেছেন। তবে কয়েক দশক ধরে সপ্তাহে ৩৮ ঘণ্টা পূর্ণকালীন চাকরি, দুই দিনের ছুটি ও চার সপ্তাহের বার্ষিক বেতনভুক্ত অবকাশ—এমন নিয়মেই চলছে। এ ছাড়া খণ্ডকালীন চাকরির প্রসার ঘটেছে, বিশেষত নারীদের কর্মবাজারে প্রবেশ বৃদ্ধির ফলে, যা পরিবার ও শ্রমবাজার উভয়কেই বদলে দিয়েছে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আসল প্রশ্ন হলো উৎপাদনশীলতার সুফল সমাজ কীভাবে ব্যবহার করবে। দেশটির প্রোডাকটিভিটি কমিশনের গবেষণায় দেখা গেছে, যদি অস্ট্রেলীয়রা গত চার দশকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বেশির ভাগ অংশ আয়ের পরিবর্তে অবসরে ব্যয় করত, তবে এখন দেশটি তিন দিনের কর্মসপ্তাহ নীতি গ্রহণ করতে পারত।
আলোচনার গভীরে গেলে দেখা যায়, বিষয়টি কেবল অর্থনীতি নয়, বরং সমাজ কোন মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। মানুষ কী চায়? উচ্চ বেতন ও বেশি ভোগ, নাকি পরিবার, স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির জন্য বেশি সময়? এটি বলা যায় যে চার দিনের কর্মসপ্তাহ নিয়ে বিতর্ক আসলে মূল্যবোধ নিয়েই। সিডনির এক মানবসম্পদ পরামর্শক মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা উৎপাদনশীলতাকে শুধু টাকার অঙ্কে মাপি। কিন্তু অনেক কর্মীর কাছে আসল উৎপাদনশীলতা হলো ঘরে ফিরে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে সন্তানদের যত্ন নেওয়া, শখ পূরণ করা বা সমাজসেবায় অংশ নেওয়া।’
অন্যদিকে নিয়োগকর্তারা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা নিয়ে চিন্তিত। এক উৎপাদনশিল্প উদ্যোক্তার ভাষায়, ‘যদি এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বীরা পাঁচ বা ছয় দিন কাজ করে, তবে অস্ট্রেলিয়া কি কেবল চার দিনে টিকে থাকতে পারবে?’
এ মুহূর্তে চার দিনের কর্মসপ্তাহ মূলত একটি আকাঙ্ক্ষা, বাস্তব নীতি নয়। তবে এ বিতর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য মনে করিয়ে দেয়, উৎপাদনশীলতার অর্থ কেবল বেশি আয় নয়। এর অর্থ হতে পারে বেশি স্বাধীনতা, সুস্থতা ও ভারসাম্য।
অস্ট্রেলিয়া হয়তো এখনই কর্মসপ্তাহ থেকে পঞ্চম দিন বাদ দিতে প্রস্তুত নয়, তবে এ আলোচনাই দেখাচ্ছে যে ভবিষ্যতের কাজ কেবল অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ নয়, এটি নির্ভর করবে আমরা সময়কে কতটা ও কীভাবে মূল্য দিই তার ওপর।