
আমি আর উল্কা হালদার। এমন দিনে এই-ই বড় সুযোগ। বাতাসে ভাসে নববর্ষের শুভেচ্ছা। মিষ্টি একটা গন্ধ তখন চরাচরে। জনসংযোগ করছি। দেখা হয় প্রিয়জনদের সঙ্গে। আমরা বিলি কেটে এগোই।
সুদীর্ঘকাল ধরে নতুন আঙ্গিক, রূপ, বর্ণ ও বৈচিত্র্য নিয়ে বাঙালির জীবনে বারবার ঘুরে আসে পয়লা বৈশাখ। এ দিন আমাদের ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জেগে ওঠে বাঙালির আত্মপরিচয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বৈশাখের এ রূপ বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে অনন্য ব্যঞ্জনায়। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বাংলা স্কুলের উদ্যোগে স্কুলের অডিটোরিয়ামে ছিল সারা দিনের আয়োজন। এখানে গানে গানে উচ্চারিত হয় মানবতা এবং শান্তির বাণী। হিংসা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে জানানো হয় ধিক্কার। অশুভকে দূরে ঠেলে বলা হয় কল্যাণের কথা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান প্রবাসী বাঙালিদের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা জানান। কবিগুরুর ভাষায়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ তিনি বলেন, অতীতের সমস্ত দুঃখ ব্যথা ভুলে বাঙালি অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাবে। মোহাম্মদ ইমরান সবার সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।
বেলা বাড়তে থাকে। নর-নারী ও শিশু-কিশোর আসে দলে দলে। মিষ্টি মুখ, পিঠা মুখের অনুষ্ঠান চলে সমান্তরালে। অডিটোরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। ভাগ্যিস, স্কুলের খেলার মাঠে তাঁবু টানিয়ে ব্যবস্থা করা হয় মুক্ত পর্দার। সেখানে বসেন দর্শক-শ্রোতা। তারা উপভোগ করেন চলতি অনুষ্ঠান। বলতেই হয়, আয়োজনে বাড়তি এ সংযোজনের জন্য দূতাবাস ও স্কুল—দুইই প্রশংসা কুড়িয়েছে ব্যাপক।
দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে, নতুন করে জেগে ওঠে বাঙালি। সকল ভয়কে জয় করার মানসে তারা একাত্ম হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি পাড়ার মানুষ আজ সমবেত কণ্ঠে গায় বৈশাখের গান। তারা আবাহন করেন বৈশাখকে। ‘এসো এসো এসো হে বৈশাখ’। আনন্দে উৎসবে মিলিত হয় সহস্রধারা। এও এক মঙ্গল শোভাযাত্রা। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি ইফতেখার হোসেন। গর্বে বুক ফুলে ওঠে, বক্তব্যেরই অংশ তার। বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন কেবল বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ নয়, ইউনেসকোর স্বীকৃতির পর এটি আজ বিশ্বজনীনতা পেয়েছে। তিনি বলেন, এটা আমাদের গর্ব।
স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ স্কুলের অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। নতুন বছর সবার জন্য আলোকিত হোক, এই প্রার্থনা করেন তিনি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আরমানুল্লাহ চৌধুরী ও কারিশমা ইনাম।
ভিড় ঠেলে এগোচ্ছি। চলতি পথে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে। ‘ধান সিঁড়ি’ স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। সেখানে দূতাবাসের কাউন্সেলর ও চ্যান্সারি প্রধান মোহাম্মদ শহীদুজ্জামান ফারুকী। তিনি বলেন, সবাইকে আজ একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই আয়োজন। ফার্স্ট সেক্রেটারি ড. মোহাম্মদ মোকসেদ আলী বলেন, আনন্দময় সময় পার করছি। অনুভব তার, যেন বাংলাদেশেই আছি। অনুষ্ঠানে গান চলছিল। দুবাই কনস্যুলেটের প্রধান শিকদার বদিরুজ্জামান গাইলেন প্রাণের গান। ভালোবাসা কুড়ালেন সবার।
পাশেই আনোয়ারা আক্তার। তিনি মেরিল্যান্ড স্কুলের শিক্ষক। তারও মমতার প্রকাশ, দূর পরবাসে বসে এমন মেলায় বাংলাদেশকেই খুঁজে পাই। নাসরিন মুস্তাফিজ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ হয়ে উঠুক মধ্যম আয়ের দেশ।
ঊর্মি হাওলাদার গান গেয়েছেন মঞ্চে। এবার তিনি দুরন্ত বৈশাখের আপ্যায়নে ব্যস্ত। ছবি তুললেন সহচরীদের সঙ্গে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলেন, প্রবাসের বুকে নেমে আসুক অঢেল শান্তি। একই জায়গায় একটু পরে দেখা হয় কান্তা চৌধুরীর সঙ্গে। কুশল বিনিময় হয়। তরুণী মায়ের ছেলে এবার প্রথম শ্রেণিতে। এ তার নববর্ষের বার্তা। রুমা তালুকদার বলেন, বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে আমরা গর্বিত। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, গলায় কিসমিস রঙের মালা, কপালে টিপ নিয়ে রুপা চৌধুরী। সামনে এগিয়ে এলেন। তৃপ্তির হাসি তার মুখে। শুভেচ্ছা জানাই আমি।
বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। পয়লা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্যে লালিত এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে সমাগত এই দিনটি সবাইকে প্রবলভাবে আপ্লুত করে। মহিলা সমিতির সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান সামনের সারিতে বসা তখন। সাধারণ মানুষকে হৃদয়বান বলে অভিহিত করেন তিনি। বলেন, আবেগ তাড়িত এই মানুষেরাই আমাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আন্না জামান। এসেছেন দুবাই থেকে। জামদানি শাড়ির সঙ্গে লাল টিপ পড়ার চর্চা তার নতুন নয়। তিনি বলেন, মিলে মিশে থাকার সংস্কৃতি বাঙালির। তারা চিরকালই অসাম্প্রদায়িক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই সারিতে কথা হয় সাহসী এক তরুণীর সঙ্গে। তিনি ব্যবসা পরিচালনা করেন। এসেছিলেন দুবাইতে চাকরি নিয়ে। তার আগে দেশে ছিলেন সেনাবাহিনীতে। এগারোটি আউটলেট তার। ৬৮ জন লোকবল নিয়ে এখানকার কো-অপারেটিভ মার্কেটগুলোতে বিপুল পণ্যের জোগান দাতা তিনি। নববর্ষের সেরা বার্তার একটি বলেই মনে হয় আমার কাছে। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই।
নৃত্যকন্যা ইমশাদ। তারই সঙ্গে নাজিফা। তারা ঘুরছে গোটা অডিটোরিয়াম। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান, বলল প্রথমা। দ্বিতীয়া জানায়, তার মামা-মামিও এসেছে আজকের মেলায়। দেখা হয় দুই কিশোরীর সঙ্গে। মেরিল্যান্ডের নবম মানের শিক্ষার্থী তারা। আনিকা বলে, সারা বছর আনন্দে কাটুক, এই কামনা। মাহমুদা ভীষণ খুশি, তার প্রকাশ, ঘুরে বেড়ানোর এমন সুযোগ সত্যিই ভাগ্যের। রাবেয়া নুর ‘আইল আইলরে’ গানে নেচেছে। ওর সঙ্গী আরও চারজন। বলল, নাচটি দারুণ দারুণভাবে উপভোগ করেছে তারা।
নওরিন এই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী। বলল, আগে নাচ করতাম এই মঞ্চে। এখনো আসি সেই টানে। তারা এসেছে পরিবারের সবাই মিলে। জানাল, এ এক অন্য ধরনের ভালো লাগা। আনিসা ও আসফি দ্বৈত নৃত্য করেছে। ‘কিনে দে কিনে দে রেশমি চুড়ি’ গানে তারা নেচেছে মনের ষোলো আনা আনন্দে। কথা হলো লামিসা আর তাসমিয়ার সঙ্গে। কী তাদের উচ্ছ্বাস! এমনতো কখনো দেখিনি, বিস্ময় ভরা সে প্রকাশ।
স্কুলের স্টল আহার বিহারের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আজিম ফজলুল কাদের এলেন আমাদের ভ্রাম্যমাণ আড্ডায়। একটু পরে আসেন একই সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ খোরশেদ ও মোহাম্মদ মঞ্জুর। ছবিয়াল বোরহান উদ্দিন তখন একটু সামনে। আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। অধ্যাপক আবু তাহের ছিলেন সেখানে। সবারই চোখে মুখে নববর্ষের আমেজ।
আমরা জড়ো হয়েছি ওখানে। এই প্রজন্মের দুই কন্যা। তারা সহোদর। আবার দুজনই ইলেকট্রিক্যাল ঘরানার। মাইশা কানাডা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ওখানেই চাকরি করছে আর ইশরা আবুধাবিতে অধ্যয়নরত। সঙ্গে তাদের সহচরী সাবিন। তাদের দেখেই বোঝা যায়, আজকের দিনটি উদ্যাপনের।
সামনের বাঁ দিকের সর্বশেষ কোণে আমরা। দলেবলে এক বহর নিয়ে আসেন হোসনে আরা ভূঁইয়া। বললেন, ভাগনে বউ, ভাস্তে বউ আর জা নিয়ে মধুময় সময় কাটাচ্ছেন। এরই একজন ফারজানা, সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছেন। এখন দুবাইয়ে। নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ তার। সাবিহা আক্তার বলেন, দূরে থাকলে বোঝা যায়, দেশ কি! এই দলের পলি খান এই আয়োজনকে ঐতিহ্যের মেলা বলে জানালেন।
মণি হোসেন উপভোগ করছেন অনুষ্ঠানের নাচ গান। ‘জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।’ তারও আশ্চর্য রকমের তৃপ্তি। পাশে উচ্ছল এক তরুণী, চামেলি আক্তার কাজল। তার নেই কোনো দল। নিজেরই ঘোষণা, তিনি স্বতন্ত্র। বলেন, পিঠা আর বাঙালির ঐতিহ্য সমার্থক।
ইষ্টি কুটুম স্টলটি ব্যস্ত। আপ্যায়ন ব্রত নিয়ে আজ তাদের তৎপরতা। বঙ্গবন্ধু পরিষদের ম আয়ুব খানই সাংগঠনিক কাজটি করে দিলেন। স্বেচ্ছা কর্মীরা বাইরের দিকে ঝুঁকলেন। ক্যামেরা জ্বলে উঠল। দেখলাম মহিলা সমিতির ‘বৈশালী’ আগাগোড়াই বেশ জমজমাট। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পপি রহমান তখন স্টলের সাজসজ্জা ঠিক রাখার দিকে মনোযোগী। অন্যরা আপ্যায়নে। সমাজকল্যাণ সম্পাদক জাকিয়া হাসান এলির চোখে মুখে উজ্জ্বলতা। তারা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন।
গান শুনি, নৃত্য উপভোগ করি। ভাসমান দর্শক, চলমান শ্রোতা আমরা। দিন এগোয়, পৌঁছায় সন্ধ্যায়। দেশই অন্তরে। সেখানে এখনো আছে অমঙ্গলের আস্ফালন। একই কারণে আছে জরা, আছে ভয়। তারপরও সবার দর্শনে, প্রাণের কথায় জুড়ায় মন। ভালো লাগার অনুভূতি। হৃদয়ের ভেতরে কেবলই আকুলি-বিকুলি। সেখানে আছে নজরুল, জল বাতাস থেকে ওঠা প্রাণের বুলবুল। ‘বৈশাখী ঝড় এলো এলোরে/ ঐ বৈশাখী ঝড় এলো এলো, মহীয়ান সুন্দর এলো এলো/ পাংশু মলিন ভীত কাঁপে অম্বর, চরাচর থরথর।।’
সাহস আর সুখে বুক ভরে ওঠে। আমরা চলি ছোট্ট কুটিরের দিকে।