দুবাই আন্তর্জাতিক একাডেমিক সিটির কফি শপগুলোতে সকালবেলা ঢুকলেই বোঝা যায়—এটি যেন ছোট্ট এক ‘জাতিসংঘ’। আরবি, হিন্দি, রুশ, সোয়াহিলি—একসঙ্গে ভেসে আসে নানা ভাষার শব্দ। ল্যাপটপে খোলা লিংকডইন, গবেষণাপত্র বা স্টার্টআপ আইডিয়া। এখানে থাকা অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই দুবাই আর ‘ট্রানজিট শহর’ নয়; এটি পড়াশোনা, ক্যারিয়ার শুরু এবং সুযোগ পেলে স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বপ্নের ঠিকানা।
সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষে দুবাইয়ের ৪১টি বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে ৪২ হাজার ২৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী—আগের বছরের তুলনায় মোট ভর্তি বেড়েছে ২০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বেড়েছে ২৯ শতাংশ, যাঁরা এখন মোট শিক্ষার্থীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি ৪০ শতাংশেরও বেশি বাড়তে পারে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুবাইয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রায় ৪২ শতাংশই ভারতীয়। তাঁদের বড় অংশ ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—অনেক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী গন্তব্যের বদলে দুবাইকেই বেছে নিচ্ছেন। এর পেছনে রয়েছে স্বল্প ফ্লাইট সময়, সাংস্কৃতিক পরিচিতি, সহজ ও অনুকূল ভিসা ব্যবস্থা এবং পড়াশোনা শেষে দ্রুত একটি গতিশীল আঞ্চলিক অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ।
এই বাড়তে থাকা চাহিদাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শাখা ক্যাম্পাস খুলছে আমিরাতে। শুধু দুবাইতেই রয়েছে বহু খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস। বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং, কর্মসংস্থান যোগ্যতা এবং ব্র্যান্ড ইকুইটিকে সামনে রেখে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী টানছে। আবুধাবি, শারজাসহ অন্যান্য আমিরাতও ধীরে ধীরে উচ্চমানের শিক্ষার গন্তব্য হিসেবে উঠে আসছে।
২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে আরও তিনটি বিশ্বস্বীকৃত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান দুবাইয়ে ক্যাম্পাস চালু করবে, এর মধ্যে ভারতের আইআইএম আহমেদাবাদও রয়েছে। একই সঙ্গে ২৫টি নতুন স্কুল, নার্সারি ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা হাজার হাজার নতুন শিক্ষার্থী আসন তৈরি করবে। সাম্প্রতিক আরেক বড় ঘোষণা হলো—দুবাই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, যেখানে প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন দিরহাম বিনিয়োগ করা হবে।
দুবাই কফি শপের লাইনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়—এটি যেন ছোট্ট এক জাতিসংঘ। আরবি, হিন্দি, রুশ, সোয়াহিলি—একসঙ্গে ভেসে আসে নানা ভাষার শব্দ। ল্যাপটপে খোলা লিংকডইন, গবেষণাপত্র বা স্টার্টআপ আইডিয়া।
দুবাই ইকোনমিক এজেন্ডা ‘ডি৩৩’-এর লক্ষ্য ২০৩৩ সালের মধ্যে শহরের অর্থনীতি দ্বিগুণ করা এবং বিশ্বে বসবাস, কাজ ও বিনিয়োগের শীর্ষ তিন শহরের একটি হওয়া। ২০২৪ সালে চালু হওয়া ‘এডুকেশন ৩৩ (ই৩৩)’ কৌশল শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক থেকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক করার প্রতিশ্রুতি দেয়—জীবনের প্রতিটি ধাপে বিশ্ববাজারে টিকে থাকার মতো দক্ষতা অর্জনের সুযোগ নিশ্চিত করতে। নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য—প্রায় ৯০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিসা ব্যবস্থাতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। ২০২২ সালে চালু হওয়া পাঁচ বছরের ‘গ্রিন ভিসা’ উচ্চ দক্ষ পেশাজীবী, সৃজনশীল ফ্রিল্যান্সার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পনসরনির্ভর ব্যবস্থার বাইরে বেশি স্বাধীনতা দেয়। শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ানো হয়েছে মেয়াদি ভিসা ও স্কলারশিপ সুবিধা। শিক্ষা খাতে প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ২০০–এর বেশি কৃতী শিক্ষাবিদকে গোল্ডেন ভিসা দেওয়া হয়েছে—যা দীর্ঘ মেয়াদে সেরা প্রতিভা ধরে রাখার কৌশলের অংশ।
শিক্ষার পাশাপাশি ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগও দুবাইয়ের বড় আকর্ষণ। নতুন ‘দুবাই ইউনিফায়েড লাইসেন্স’ ব্যবস্থায় মাত্র পাঁচ দিনে ব্যবসার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব—আগে যা লাগত প্রায় ৬৫ দিন। এই ধরনের প্রক্রিয়াগত সহজীকরণ একজন গ্র্যাজুয়েটের চূড়ান্ত প্রকল্পকে স্টার্টআপে রূপ দেওয়ার পথ খুলে দেয়।
তবে উজ্জ্বলতার আড়ালে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া ও মাসিক খরচ বাড়ছে। তবু বৈশ্বিক স্বপ্ন দেখা শিক্ষার্থীদের কাছে লেকচার হল থেকে ইন্টার্নশিপ, সেখান থেকে প্রযুক্তি কোম্পানি, ব্যাংক, কনসালট্যান্সি বা মিডিয়া হাউসে চাকরি—এই রূপান্তর দিন দিন আরও বাস্তব হয়ে উঠছে।