সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজ, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫
সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজ, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

সাত কলেজশিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ কেন মুখোমুখি হলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অবকাঠামো, শিক্ষকসংখ্যা, আবাসন, পরিবহন, শিক্ষার্থীপ্রতি বরাদ্দ, সমাবর্তন, ক্লাস রুটিন, সিলেবাস, মানোন্নয়ন, পরীক্ষাব্যবস্থা ও ফলাফলসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যের শিকার। অধিভুক্তির মাত্র পাঁচ মাস পর, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফল প্রকাশ ও নিয়মিত পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে প্রথমবারের মতো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয় তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অসংগতি, প্রশাসনিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এসব দাবিদাওয়া ঘিরে ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বারবার রাস্তায় নামতে হয়েছে। পূর্বপ্রস্তুতিবিহীন লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অধিভুক্তির চাপে নুইয়ে পড়া পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, রেজিস্ট্রার ও বিভাগগুলো অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা যারপর নাই ভোগান্তিতে পড়ে এবং এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ২০২৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষার্থীরা স্থায়ী সমাধানের খোঁজে রাজপথ বেছে নেয়।

শুরুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা—প্রয়োজনে আলাদা ভবন নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই সমাধান নিশ্চিত করা। পরে সেটি রূপ নেয় সাত কলেজকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে, যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে সৃষ্ট পরীক্ষাব্যবস্থা, ফল প্রকাশ, সেশনজটসহ দীর্ঘদিনের বিভিন্ন সমস্যার অবসান ঘটে।

সাত কলেজের প্রশাসনিক ও একাডেমিক সংকট সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। সেখানে কার্যপরিধির–০২–এ স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করে কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রূপান্তরের প্রক্রিয়া নির্ধারণ ও বিকল্পগুলো বিবেচনা করা। কিন্তু কমিটি কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে হাইব্রিড ও স্কুলিং পদ্ধতিসংবলিত অনলাইননির্ভর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ২.০ (BOU 2.0) মডেল প্রস্তাব করেছে, যা সরাসরি সাত কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও পরিচয় বিলুপ্ত করবে।

শিক্ষার বাণিজ্যকরণ রোধ, উচ্চশিক্ষা সংকোচন ও স্বাধীনতা রক্ষাসহ আট দফা দাবি নিয়ে সাত কলেজে কর্মরত শিক্ষকেরা একই দিনে একই সময়ে প্রতিটি কলেজে মানববন্ধন করেন। ঢাকা কলেজসহ পাঁচটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা নিজভূমে পরবাসী অথবা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে দফায় দফায় আন্দোলন করে দাবি জানায় কলেজের সম্পত্তি কোনোভাবেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হস্তান্তর করা যাবে না। সহশিক্ষা চালু ও নারীশিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধতা করে ইডেন কন্যাদের একটি বড় অংশ নীলক্ষেতসংলগ্ন রাজপথ অবরোধ করে।

আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করেছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা
২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হতে গেলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। শিক্ষকেরা বলেন, তাঁরা কলেজশিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও ক্লাস নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই।

সময়ের পরিক্রমায় অদৃশ্য কারণে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একটি খণ্ডিতাংশের দাবি বহতা নদীর মতোই বাঁক নিতে থাকে—তারা স্কুলিং পদ্ধতির দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে, অথচ সাত কলেজ থেকে ইউজিসিতে ৪টি, ঢাকা কলেজ থেকে ৫টি দল যায় মডেলসংক্রান্ত আলোচনার জন্য; সেখানে তাদের পক্ষ থেকে প্রেজেন্টেশনে স্কুলিং পদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়নি বলে খোদ শিক্ষার্থীদের অপর একটি অংশ দাবি করেছে। অংশীজনদের মতামত গ্রহণের ধারাবাহিকতায় সুধীজনের মতামত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম শুরুর নোটিশ প্রদান অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

অধ্যাদেশের ৬–এর ২(ক) ধারায় বলা আছে, ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজসমূহের বিরাজমান পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো ও অন্যান্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকিবে’ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ব্যবহৃত ‘উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা’ বাক্যাংশটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কাঠামো বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে, যা সাত কলেজ ইস্যুকে আরও জটিল করে।

২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হতে গেলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। শিক্ষকেরা বলেন, তাঁরা কলেজশিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও ক্লাস নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। শিক্ষকদের যুক্তি অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই, কেননা অধ্যাদেশের ২(ফ) অনুসারে তাঁরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন, কিন্তু ২(ব) অনুসারে ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফলে তাঁরা যাদের শিক্ষক নন, তাদের ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি।

সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা পরিষদের ব্যানারে সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোতে মানববন্ধন করেছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ঢাকা কলেজের সামনে

প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অথবা তার সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধীন সরকারি সাত কলেজে ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ক্লাস শুরু করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সনাতন কাঠামোয় ভর্তি হওয়া ২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষের এই দাবিকে শিক্ষকেরা অত্যন্ত ইতিবাচক এবং শিক্ষার্থী সুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসুক—এটি যেমন অভিভাবকদের প্রত্যাশা, তেমনি সাত কলেজের শিক্ষকদেরও কামনা।

কিন্তু বাদ সাধে যখন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, অথচ স্কুলিং পদ্ধতিতে অধ্যাদেশ দাবি করা স্নাতক পর্যায়ের খণ্ডিতাংশটি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ প্রণয়নের দাবিতে রাস্তায় নামে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক পর্যায়ের অপর অংশ এবং শিক্ষকেরা আলাদা আলাদা ব্যানারে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেন। ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করতে যাওয়ার পথে ইডেন কলেজের ছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর ঢিল ছোড়া হয় এবং প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছালে সেখানে বেশ কিছু সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল স্কুলিং পদ্ধতি দাবি করা স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা; পরে পুলিশের উপস্থিতি এবং ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রদের উপস্থিতিতে তাঁরা নিরাপদে ফিরে যান।

উল্লেখ্য, এই একই গোষ্ঠী অতীতেও বিভিন্ন সময়ে উচ্চমাধ্যমিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, নারী শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, বডি শেমিং, সাইবার বুলিং এবং মিডিয়া ট্রায়ালসহ বিভিন্ন নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এমন ঘটনাকে ধারাবাহিক উগ্রতা ও সহিংস প্রবণতা—শিক্ষাঙ্গনকে অস্থিতিশীল করার একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা হিসেবেই দেখছে নাগরিক সমাজ।

এই ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশের সব সরকারি কলেজে শিক্ষকেরা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পূর্বে জগন্নাথও সাত কলেজের ন্যায় সরকারের বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের কর্মস্থল ছিল। সেখানে প্রথম দিকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা পাঠদান করলেও কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর প্রক্রিয়া শেষে সবাইকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তাদের প্রায় ৪০০ পদ সংকোচন হয়। হালের পদোন্নতির ক্ষেত্রে শূন্য পদের সংকটের অন্যতম কারণ হিসেবে জগন্নাথের সেই ঘটনাকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা।

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়—ফলে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের স্থায়ী অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের ক্লাসরুমে ফেরানো সহজ হবে না। যেহেতু শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন এবং সামাজিক মাধ্যমে কলেজশিক্ষকদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করছেন—এসব মন্তব্য শিক্ষকদের মনস্তত্ত্বে কিরূপ প্রভাব ফেলবে, সেটি পাঠদানকে ব্যাহত করবে কি না ভেবে দেখতে হবে; একইভাবে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে কি না, তা আমলে নিতে হবে।

২০২৪–২৫ শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলিং পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার স্বার্থে আলাদা জায়গায় প্রস্তাবিত ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাত কলেজের বিচ্ছেদ হয়েছে, তাই সরকার উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে শিক্ষার্থীর জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ বৃদ্ধি, আবাসন, পরিবহন, শিক্ষকসংকট ও অন্য সমস্যার সমাধানে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করে বর্তমান শিক্ষার্থীদের সনদ প্রদানের নিমিত্তে কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে নতুন কাঠামোর সর্বস্তরে স্থায়ীভাবে কেবল বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে অধিভুক্তিমূলক, ফেডারেল অথবা কলেজিয়েট মডেলে সাত কলেজকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরাতে পারে।

লেখক: সচিব তালুকদার ও অরিয়ন তালুকদার, শিক্ষক