
‘ম’ বর্ণের সঙ্গে ‘আ-কার’ যুক্ত করে দিলে যে শব্দটি গঠিত হয়, সেটি আর শুধু একটি শব্দ থাকে না। বরং হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন আস্থার নাম, একটি বিশ্বাস ও মমতার নাম। মা যেমন তাঁর সন্তানকে সব সময় বুকে আগলে রাখেন, তেমনি সন্তানেরও তার মায়ের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। যদি বলা হয়, মাকে নিয়ে তৈরি সেরা চলচ্চিত্র কোনটি, তাহলে নানা মত তৈরি হবে। আসলে মাকে নিয়ে যত ছবিই তৈরি হোক না কেন, তা মাকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারে না।আমরা বরং মাকে নিয়ে তৈরি একটি চলচ্চিত্র নিয়েই কথা বলি। বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক এলেন জে পাকুলার রচনা ও পরিচালনায় সোফি’স চয়েস (ডিসেম্বর ৮, ১৯৮২) চলচ্চিত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে দুই সন্তানের জননী সোফির যে ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে, তা ছবিটিকে মাকে নিয়ে তৈরি ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবির আসনে অধিষ্ঠান দিয়েছে।মার্কিন লেখক উইলিয়াম স্টাইরনের বিখ্যাত উপন্যাস সোফি’স চয়েস (১৯৭৯)-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে ছবিটি। এতে মায়ের ভূমিকায় (সোফি) অভিনয় করে ১৯৮২ সালের সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অস্কার জিতেছেন মেরিল স্ট্রিপ। আরও দুটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পিটার ম্যাকনিকোল (স্টিংগো) ও কেভিন ক্লাইন (নাথান)। ছবিতে সোফিকে একজন পোলিশ নারী হিসেবে দেখানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার স্বামীকে মেরে তাকে দুই সন্তানসহ অসচিটজ নির্যাতন ক্যাম্পে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে দুই সন্তানের মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে চাপ দেওয়া হয়। দুজনকেই মেরে ফেলা হবে—এই দুশ্চিন্তায় সে বাধ্য হয়ে বেছে নেয় তার ১০ বছর বয়সী ছেলেকে। ইয়ানকে পাঠানো হয় শিশুদের ক্যাম্পে আর পিচ্চি মেয়ে ইভাকে মেরে ফেলা হয়। সোফি যখন একজন নাৎসি কর্মকর্তার বাড়িতে সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিল, তখন একজন গুপ্তচর তাকে ছেলের খবর এনে দেবে বললে তার কথামতো নিজের জীবন বাজি রেখে রেডিও চুরি করতে গিয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় সে। তবু সে চেষ্টা চালিয়ে যায়। সেই কর্মকর্তার সেবা করে, এমনকি হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করে সে নির্দোষ। এবং তাকে মুক্তি না দিয়ে যেন তার ছেলেকে মুক্তি দেওয়া হয়। নাহলে অন্তত যেন একজন ভালো জার্মান হিসেবে সে গড়ে উঠতে পারে। বহুদিন পর ছেলেকে দেখতে পাবে বলে সারা রাত আশায় বুক বেঁধে ছিল মা। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় সে কী আনন্দ! সত্যিই দেখার মতো। কিন্তু সে পাষণ্ড কর্মকর্তা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। ছেলে কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না এ নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকত স্নেহময়ী মা সোফি। কোনো দিন সে জানতে পারেনি তার ছেলের শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি হয়েছিল। যদিও তার পক্ষে করার কিছুই ছিল না, তবু একজন মা হিসেবে সোফি এটা কখনোই মেনে নিতে পারেনি এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কষ্টটাকে সে বুকের গহিনে লুকিয়ে রাখত। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর নাথানকে ভালোবেসে সে যেমন সুখী হতে পারেনি, তেমনি কম বয়সী লেখক স্টিংগোর ভালোবাসা এবং বিয়ের প্রস্তাবও তাকে সন্তান হারানোর জ্বালা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাবা-মা, স্বামীকে হারিয়েও সে যতটা ভেঙে পড়েনি, মেয়েকে হারিয়ে সে তার চেয়ে অনেক বেশি ভেঙে পড়েছিল। এই অনুতাপ সইতে না পেরে শেষে পাগল প্রেমিক নাথানের সঙ্গে সায়ানাইড গ্রহণে আত্মহত্যা করে। এভাবেই একজন স্নেহময়ী মা তার সন্তানদের জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা সইতে না পেরে জগতের সব সুখ ছেড়ে পালিয়ে যায় না-ফেরার দেশে।
ছবিটি দেখুন। ভালো লাগবে।