
ঢুকতেই কর্পূরের গন্ধ... অতঃপর কবি মেহেরুন্নেসার হিমশীতল হাতের স্পর্শ, এক চুমুক মিষ্টি শরবত, তারপর কবি মেহেরুন্নেসা শুরু করলেন একাত্তরের সেই নৃশংস ঘটনার কথা... চোখের সামনে তাঁর দুই ভাইকে হত্যার বিবরণ। অতঃপর মায়ের এবং নিজের মৃত্যুর সবিশেষ বর্ণনা দিয়ে চললেন তিনি। মিরপুর বেনারশি পল্লির শেষ মাথায় একাত্তরের জল্লাদখানায় মেহেরুন্নেসার পাশে হাঁটতে হাঁটতে এই বিবরণ শুনে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। একসময় কবি তাঁর অঙ্গুলি নির্দেশে দেখালেন একটি কূপ। যেখানে ১৯৭১ সালে অসংখ্য বাঙালিকে ধরে নিয়ে এসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠল।
একটু পর আরেকজন আমার হাত ধরে কিছুটা পথ হেঁটে তাঁর গল্প বলতে থাকেন হিশহিশ শীতল কণ্ঠে। তাঁকে কী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। এভাবে একের পর এক সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, গৃহিণী, ছাত্র, শিশু হত্যার গল্প ও দৃশ্যায়ন দেখে আমি নির্বাক-নিথর। খন্দকার আবু তালেব, ডা. জইন উদ্দিন, ডা. গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, বরকত আলী মোল্লা, কাশাবাদ্দৌজা, ১৫-১৬ বছরের মলফত হোসেন, রমিজউদ্দিন, মোহাম্মদ মাহবুব, মো. তোরাব আলী, জহরজান বেগম, ১৪ বছরের রমিজউদ্দিন, শেখ জাকারিয়া—এমন অনেকে তাঁদের দুঃখগাথা মৃত্যুর গল্প শুনিয়ে আমাকে ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী করে তোলেন।
বলছি যুদ্ধ পুরাণ নাটকের কথা। ঢাকার মঞ্চে প্রায় একই ধাঁচের নাটকের বিপরীতে এটি এক অন্য ধরনের প্রযোজনা। মঞ্চ ও দর্শকের সারির দূরত্ব ঘুচিয়ে যুদ্ধ পূরাণ আমার পাশে পাশে হেঁটে আমাকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গল্প শোনাল। ঘাতক-দালালদের প্রতি আমার রাগ ও ঘৃণাকে আরও একপ্রস্থ বাড়িয়ে তুলল। অভূতপূর্ব।
দেশ-বিদেশের অনেক নাটক ও লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে কিন্তু জল্লাদখানায় যাঁদের এনে হত্যা করা হয়েছিল, তাঁদের সেই স্থানেই জীবন্ত করে তাঁদের মুখে নিজেদের গল্প বলা; সঙ্গে জিল্লুর রহমানের এমন সুন্দর পরিমিতি বোধসম্পন্ন আলো এবং অজয় দাসের শব্দ সংযোজন এককথায় অসাধারণ।
দর্শকের সারিতে দাঁড়িয়ে যখন প্রযোজনা দেখার জন্য জল্লাদখানার বাইরে অপেক্ষা করছি, ঠিক তখন লম্বা হুডসহ কালো একটা আলখাল্লা ধরনের পোশাক সবাইকে দেওয়া হলো নিজেদের আবৃত করে নেওয়ার জন্য। এরপর প্রযোজনা দেখতে জল্লাদখানার গেট দিয়ে প্রবেশ করে দেখি অভিনয়শিল্পীরা সবাই আমাদের মতো একই পোশাকে আবৃত। দর্শক ও অভিনয়শিল্পীদের এক কাতারে দাঁড় করানোর জন্য এই অভিনব পোশাকের পরিকল্পনা প্রযোজনাটিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর জন্য প্রশংসার দাবিদার শেখ মোহম্মদ এহসানুর রহমান ও পারভীন কণার—যাঁরা এই পোশাকের পরিকল্পনা করেছেন। এই নাটকে আলাদাভাবে সেট ডিজাইনের প্রয়োজন পড়েনি, সমগ্র জল্লাদখানাই সেট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কালো আলখাল্লায় মোড়ানো শহীদেরা এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝখানের অংশটাতে গণহত্যার শিকার অসংখ্য লাশ। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং নির্মমতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। মৃত ব্যক্তিদের জীবিত করে দর্শকের সামনে দাঁড় করানোর জন্য যে রূপসজ্জার প্রয়োজন; এ কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন শুভাশীষ দত্ত তন্ময়। ইতিহাসনির্ভর নাটকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হলো যথাযথ গবেষণা। সেই কাজটা যথাযথভাবেই সম্পন্ন করেছে নাটকের গবেষণা দল। দলের সদস্য কামাল খান, আশফাকুর রহমান আশিক, সুইট হাসান, আবু ইসলাম মোহম্মদ ইতিহাস, হুমায়ুন কবীর টিটোকে আমার অভিনন্দন।
নাটকের কলাকুশলী ও অভিনয়শিল্পীদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামনে রেখে সময়োপযোগী করে নাট্যভাবনা ও প্রয়োগ করার জন্য কাজী আনিসুল হক বরুণকে আমার সাধুবাদ জানাই।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ভাইকে অনুরোধ করব, এই নাটকটি সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ওই জল্লাদখানায় মঞ্চস্থ করা যায় কি না ভেবে দেখার জন্য। আমাদের দেশের যেসব যুবা ভুল পথে চলেছেন কিংবা যাঁরা সঠিক পথের নিশানা পাননি এখনো, তাঁদের এ নাটকটি দেখানো অত্যন্ত জরুরি।