ভারতীয় অভিনেতা ফাহাদ ফাসিলের জন্মদিন আজ। ১৯৮২ সালের আজকের এই দিনে কেরালায় জন্ম তাঁর। মালয়ালম থেকে তামিল, তেলেগু সিনেমায় তিনি শুধু দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেননি, বরং অভিনয়ের আলাদা এক জগৎ তৈরি করেছেন। অনেক চলচ্চিত্র সমালোচকের ভাষ্যে, ফাসিল ভারতের সেই অভিনেতাদের একজন, যাঁরা কেবল চোখ দিয়েই অভিনয় করতে পারেন। তাঁর নীরব চাহনি সংলাপ থেকেও শক্তিশালী। কয়েক বছর আগে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যারিয়ার ও জীবনদর্শন নিয়ে কথা বলেছিলেন এই অভিনেতা। জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক জীবন নিয়ে কী ভাবেন ফাহাদ ফাসিল।
ভাগ্যে প্রচণ্ড বিশ্বাসী ফাহাদ ফাসিল। এই অভিনেতা মনে করেন, তাঁর জীবনে যা কিছু ঘটেছে, সবই ভাগ্যের লিখন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাগ্যের লিখনে আমি বিশ্বাসী, না হলে কীভাবে বোঝাব—খ্যাতিমান মা–বাবার সন্তান হয়েও প্রথম ছবিতে ব্যর্থতা, তারপর অভিনয় ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দর্শন পড়া, অভিনয় না করার ইচ্ছা নিয়ে দেশে ফিরেও দর্শকের এমন ভালোবাসা!’
ফাহাদের অভিনয়ে অভিষেক ২০ বছর বয়সে, ২০০২ সালে তাঁর বাবা ফাসিলের পরিচালনায় রোমান্টিক-কমেডি ‘কাইয়েথুম দুরাথ’ ছবিতে। এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ছবিটি বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। অভিনয় নিয়েও কটাক্ষের শিকার হন ফাহাদ ফাসিল। অনেকটা অভিমান করেই সিনেমা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সাত বছর পর ২০০৯ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তখন ক্যারিয়ার কোন দিকে নেবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। বন্ধুদের সবাই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্ত থাকায় তাঁদের পরামর্শেই অভিনয়ে ফেরেন। অ্যান্থলজি সিনেমা ‘দ্য কেরালা ক্যাফে’র একটি গল্পে তিনি সাংবাদিকের চরিত্রে পর্দায় ফেরেন।
এ–ও শোনা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় প্রয়াত বলিউড অভিনেতা ইরফান খানের একটি ছবি দেখেছিলেন ফাহাদ। তা দেখার পর আবার অভিনয় নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করার অনুপ্রেরণা পান। তাই পড়াশোনা ছেড়ে ভারতে চলে যান তিনি।
ফাহাদ ফাসিল ক্যারিয়ারে প্রথম সফলতার মুখ দেখেন ২০১১ সালে। ‘চাপ্পা কুরিশু’ সিনেমা দিয়ে পরিচিতি পান। এর জন্য কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জেতেন।
২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া দুই ছবি ‘টোয়েন্টি টু ফিমেল কোট্টায়াম’, ‘ডায়মন্ড নেকলেস’ অভিনেতা হিসেবে ফাহাদের জায়গা পাকা করে দেয়। তবে তখনো ‘বেঙ্গালোর ডেজ’ মুক্তি পাওয়া বাকি। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া অঞ্জলি মেননের ছবিটি বক্স অফিসে সফলতার সঙ্গে ফাহাদ ফাসিলের অভিনয় দর্শকের মন কাড়ে। এরপর ‘মাশেশিনতে প্রাথিকারম’, ‘টেক অফ’, ‘থন্ডিমুথালুম দৃকসাক্ষিয়ুম’, ‘নিজান প্রাক্ষান’, ‘ট্রান্স’-এর মতো সিনেমা দিয়ে মালয়ালম সিনেমার সেরা অভিনেতাদের একজন হয়ে ওঠেন ফাহাদ ফাসিল।
২০১৮ সালে ‘থন্ডিমুথালুম দৃকসাক্ষিয়ুম’–এ অভিনয় ফাহাদ ফাসিলকে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দেয়। অভিনেতা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পান মহামারির সময়। লকডাউনে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকায় তাঁর কয়েক ছবি ওটিটিতে মুক্তি পায়। ‘সি ইউ সুন’, ‘জোজি’, ‘ইরুল’ দেখে ফাসিলের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে ‘সুপার ডিলাক্স’ দিয়ে তামিলে অভিষেক হয় ফাহাদ ফাসিলের। ছবিতে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা পান। অনেক সমালোচকের মতে, সে বছর ভারতে সেরা ছবি ছিল ‘সুপার ডিলাক্স’। ২০২১ সালের বহুল আলোচিত ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’-এ অল্প সময়ের উপস্থিতিতেও নিজের ঝলক দেখিয়েছেন তিনি। সেটা ছিল অভিনেতার প্রথম তেলেগু ছবি। এরপরের বছর আরেকটি ব্লকবাস্টার তামিল ছবি ‘বিক্রম’ ছবিতেও ছিলেন ফাসিল।
২০২৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পুষ্পা ২: দ্য রুল’ ছবিতেও অভিনয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন ফাহাদ ফাসিল। তা ছাড়া ‘বরাথন’, ‘কুম্বলঙ্গি নাইটস’, ‘মালিক’, ‘আবেশম’ ও ‘বোগেনভিলিয়া’র মতো একাধিক দক্ষিণি ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি।
মালয়ালমের বাইরে বিভিন্ন দক্ষিণি ছবি করলেও বলিউডে কাজের তেমন ইচ্ছা নেই অভিনেতার। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি যে ধরনের ছবি করতেন, সে ধরনের কনটেন্ট মালয়ালমেই আছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে বলিউডে কাজের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেননি তিনি। ফাহাদ ফাসিলের অভিনয়ের বড় বৈশিষ্ট্য সাবলীলতা। পাশের বাড়ির ছেলে, ধর্মগুরু, ভিলেন থেকে রাষ্ট্রদূত—যেকোনো চরিত্রেই মানিয়ে যান তিনি।
অভিনেতা মনে করেন, ছোট পর্দায় সাবটাইটেলসহ ছবি দেখা এখন সহজ হয়ে গেছে, ভাষাজনিত সমস্যা কেটে গেছে। এতে বেশ উচ্ছ্বসিত তিনি। ফাহাদ বলেন, ‘দেখুন “সিটি অব গড”-এর কী হয়েছিল। এ ছবিটি ছিল একটি নির্দিষ্ট শহরকে কেন্দ্র করে, কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে, কয়েকবার করে দেখেছে, ভালোবেসেছে। আমিও আমার কেরালার বন্ধুদের সঙ্গে দেখেছি। এটাই “গ্লোবাল” দর্শকের শক্তি।’
প্রায় দুই যুগের ক্যারিয়ারে ৬০টির মতো ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করেছেন ফাহাদ ফাসিল। এর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রে তাঁকে পার্শ্বচরিত্রে দেখা গেলেও তাঁর অভিনয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রধান চরিত্রের চেয়েও বেশি। কিন্তু ফাহাদ ফাসিল এখনো তৃপ্ত নন। অভিনেতার ভাষায়, তিনি এখনো অসাধারণ কিছু করে ফেলেননি। ফাহাদ ফাসিল বলেন, ‘এখনো সেই ছবির অপেক্ষায় আছি, যার পর আমি আমার সাফল্যের কথা বলতে পারব।’
কোনো চরিত্র হাতে পাওয়ার পর ফাহাদ ফাসিল নিজেকে যে প্রশ্ন প্রথমে করেন, তা হলো ‘এটা কি দেশের মানুষের মনে দাগ কাটবে?’
ক্যারিয়ারে এখন যেখানে আছেন, এর জন্য তিনি সব সময় স্মরণ করেন তাঁর প্রথম ছবির কথা। ছবিটির বক্স অফিস ব্যর্থতা তাঁকে জীবন নতুন করে চিনিয়েছিল। ফাহাদ ফাসিল বলেন, ‘জীবনের এ অভিজ্ঞতা আমাকে মাটিতে পা রাখতে শিখিয়েছে।’
ভালো অভিনেতার পাশাপাশি নিজের অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্যও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন ফাহাদ ফাসিল। সম্প্রতি এই মালয়ালম অভিনেতার ‘বাটন ফোন’ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। গত বছরের জুলাই মুক্তি পায় তাঁর সিনেমা ‘মারিসান’। মুক্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ফাহাদ ফাসিল। ওই সময় তাঁকে একটি বাটন ফোন ব্যবহার করতে দেখা যায়।
হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়াকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ফাহাদ ফাসিল জানিয়েছেন, স্মার্টফোন থেকে দূরে আছেন তিনি। বাটন ফোনই এখন সঙ্গী তাঁর। তবে ভবিষ্যতে সেটাও ছেড়ে দিতে চান। অভিনেতা বলেন, ‘এক বছর ধরে আমি ডাম্ব ফোন ব্যবহার করছি। পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে মুঠোফোন ব্যবহার করা ছেড়ে দেব। শুধু ই-মেইলেই পাওয়া যাবে আমাকে। স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। যদিও আমি নিশ্চিত নই, এটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে কি না!’
ফাহাদ ফাসিল এ–ও জানিয়েছেন, স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও তিনি ইন্টারনেট থেকে দূরে নন। প্রয়োজন হলে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন অভিনেতা। তবে কোনো ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নেই। অভিনেতা বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক আগে ছিলাম। তখনো আমি এটা খুব ভালো ব্যবহার করতে পারতাম না। কী পোস্ট করতে হবে, কী কমেন্ট করতে হবে—জানতাম না। তবে আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কিছু যেন পোস্ট না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতাম।’
ফাহাদ ফাসিল এখন চেষ্টা করছেন সময়কে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে। নিজের জীবনকে রুটিনে আনার চেষ্টা করছেন, যাতে আরও বেশি কাজ করতে পারেন। কোনো ধরনের অপ্রয়োজনীয় বিষয় যেন তাঁর মনোযোগ কেড়ে নিতে না পারে। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করার কারণে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় কি তিনি পান না? ফাহাদ ফাসিলের স্পষ্ট উত্তর, ‘যেদিন থেকে আমি খারাপ সিনেমা করা শুরু করব, শুধু তখনই আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। অন্য কোনো কিছুই আমাকে দর্শকের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’