‘জলি এলএলবি ৩’ সিনেমার পোস্টারে আরশাদ ওয়ার্সি ও অক্ষয় কুমার। আইএমডিবি
‘জলি এলএলবি ৩’ সিনেমার পোস্টারে আরশাদ ওয়ার্সি ও অক্ষয় কুমার। আইএমডিবি

একসঙ্গে হাজির দুই জলি, এরপর...

সুভাষ কাপুর আগে ছিলেন সাংবাদিক, কাজের বিষয় ছিল রাজনীতি। পরে যখন নির্মাতা হন, সিনেমাতেও উঠে আসে রাজনীতি। তবে তিনি সিরিয়াস বিষয় পর্দায় তুলে ধরেন হাস্যরসের মাধ্যমে। ‘ফাঁস গায়ে রে ওবামা’, আর ‘জলি’ ফ্র্যাঞ্চাইজির দর্শকমাত্রই সেটা জানেন। আলোচিত ‘জলি এলএলবি’ আর ‘জলি এলএলবি ২’-এর পর এবার তিনি হাজির তৃতীয় কিস্তি নিয়ে। এবার তিনি কোর্ট রুম ড্রামার মোড়াকে ভারতের কৃষিসংকট, কৃষকদের আত্মহত্যা নিয়ে কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আগের দুই কিস্তির মতো এবারও তিনি ‘জলি এলএলবি ৩’-এর হাস্যরসের আড়ালে কঠিন রাজনৈতিক বার্তা দিতে পারলেন?

একনজরেসিনেমা: ‘জলি এলএলবি ৩’ধরন: কোর্ট রুম ড্রামাপরিচালক: সুভাষ কাপুরঅভিনয়: অক্ষয় কুমার, আরশাদ ওয়ার্সি, সৌরভ শুক্লা, গজরাজ রাও, হুমা করেশিস্ট্রিমি: নেটফ্লিক্সরানটাইম: ২ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট

‘জলি এলএলবি ৩’ নির্মাতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ, এবার তিনি সাহস করে অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হলো, সিনেমা হিসেবে সম্ভবত এটা এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সবচেয়ে দুর্বল। দুই জলি আরশাদ ওয়ার্সি আর অক্ষয় কুমার এই সিনেমায় হাজির হয়েছেন একসঙ্গে কিন্তু দুর্বল চিত্রনাট্যের কারণে তাঁদের যুগলবন্দী আর মনে রাখার মতো হলো কই।

শুরুটা যদিও ছিল আশাজাগানিয়া। জগদীশ ত্যাগী (আরশাদ ওয়ার্সি) ও জগদীশ্বর মিশ্র (অক্ষয় কুমার)—দিল্লির একই আদালতে কাজ করছেন। জগদীশ্বর, যিনি নিজেকে ‘অরিজিনাল জলি’ দাবি করেন, ক্লায়েন্ট ছিনিয়ে নেন ও নিয়মিত ঝগড়া করেন। এবার নির্মাতা পুরোনো কয়েকটি চরিত্র ফিরিয়ে এনেছেন, তাঁদের দিনযাপনও আছে আগের মতোই। যেমন জগদীশ্বরের স্ত্রী পুষ্পা (হুমা কুরেশি) আগের মতোই সুরা আসক্ত। তবে বিচারক সুন্দরলাল ত্রিপাঠি (সৌরভ শুক্লা) বদলে গেছেন, এখন ফিটনেস প্রেমিক। নিয়মিত জিম করেন, প্রোটিন শেক নেন। এমনকি ডেটিং অ্যাপেও নাম লেখাতে ভোলেননি।

‘জলি এলএলবি ৩’ সিনেমায় আরশাদ ওয়ার্সি ও অক্ষয় কুমার। আইএমডিবি

গল্প জমে ওঠে যখন দুই জলি শত্রুতা ভুলে এক গুরুত্বপূর্ণ কেসের জন্য এক হন। একত্র হয়ে তাঁরা জনাকি (সীমা বিশ্বাস) নামের এক নারীর পাশে দাঁড়ান, যার কৃষক স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। সিনেমাটি ২০১১ সালে ভারতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, যখন উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানে অবশ্য উত্তর প্রদেশের বদলে পটভূমি রাজস্থান; কিন্তু নির্মাতা পুঁজিবাদ আর উন্নয়নের রাজনীতি নিয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে পিছপা হননি। দুই জলিকে এবার লড়তে হয় বিলিয়নিয়ার হরি ভাই খৈতানের বিরুদ্ধে, যিনি কৃষকদের উচ্ছেদ করে বিভিন্ন রাজ্যে নিজের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করছেন। এমন হেভিওয়েট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কি পেরে উঠবে দুই জলি?

বিলিয়নিয়ার হরিভাই খৈতানের চরিত্রে গজরাজ রাও দারুণ। বিশেষ করে তাঁর টাক মাথার লুক, ক্রুর চাউনি আর শয়তানির হাসি ছবিতে উত্তেজনা ধরে রাখে। ছবিতে তিনি একজন ক্ষমতাশীল ব্যবসায়ী, যিনি দেশের উন্নয়নের পথে দারিদ্র্যকে বাধা মনে করেন। সিনেমার একটি দৃশ্যে তিনি রাজস্থানের মরুভূমিতে নির্মিত রেসিং সার্কিটের ব্যালকনিতে রোমান সম্রাটের মতো বসে রেস দেখেন, যেন এটি তার ব্যক্তিগত কলোসিয়াম।

‘জলি এলএলবি ৩’ সিনেমার পোস্টার থেকে।আইএমডিবি

সৌরভ শুক্লাও নিজের চরিত্রে যথাযথ, স্রেফ লাজুক হাসিতেই মাত করতে পারেন তিনি। দুই জলির স্ত্রীর চরিত্রে হুমা কুরেশি আর অমৃতা রাও গড়পড়তা, চিত্রনাট্যে তাদের উপস্থিতি এতই কম যে দুই অভিনেত্রীর সেভাবে কিছু করারও ছিল না। তবে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির মূল জাদু তো জলি, এবার কমেডি চরিত্রে দুই পরীক্ষিত অভিনেতা আরশাদ ওয়ার্সি আর অক্ষয় কুমার যখন হাজির; প্রত্যাশার পারদ চড়তে বাধ্য। এখানেই সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে সিনেমাটি।

দুটি প্রধান চরিত্রের অভিনেতাদের কমেডি দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ‘জলি এলএলবি ৩’ সেই চিত্তাকর্ষক কমেডি হয়ে ওঠে না। না কমেডি না দ্বন্দ্ব; দুজনের রসায়ন সেভাবে জমেনি। আদালত কমপ্লেক্সে জোর করে একটি লড়াই দেখানো হয়েছে, যা আসলে ভুলে যাওয়ার মতোই। একটি অ্যাকশন দৃশ্য দেখে মনে হয়, অন্য একটি অক্ষয় কুমার সিনেমা থেকে ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে। ছবির সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তগুলো দেওয়া হয়েছে অক্ষয় কুমারকে, তিনি বড় তারকা বলেই? একেবারে শেষে আরশাদ ওয়ার্সিকে ফেরানো তাই ‘সান্ত্বনা পুরস্কারের’ মতো মনে হয়।

‘জলি এলএলবি ৩’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

সিনেমাজুড়ে সামাজিক বার্তা আর কমেডির যথাযথ সমন্বয় করতে হিমশিম খেয়েছেন নির্মাতা। দেখেতে দেখতে কখনো মনে হয়, ‘বাহ’! পরক্ষণেই আবার চিত্রনাট্য খেই হারায়। একটি দৃশ্যে অক্ষয় কুমার আদালতকে অনুরোধ করেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কৃষি বিষয়ে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে। যেন শিক্ষার্থীরা জানতে পারে, খাবার কৃষক উৎপাদন করে, অনলাইন অ্যাপ নয়। এমন সংলাপ যেমন হাসায় তেমনই ভাবায়ও।
কিন্তু মুশকিল হলো, এ ধরনের মুহূর্ত সিনেমায় আসে বিচ্ছিন্নভাবে; তাই ‘জলি এলএলবি ৩’ এই ফ্র্যাঞ্চাইজির নামের সঙ্গে সুবিচার করতে পারে না। বলিউডের সিনেমায় আজকাল রাজনীতি থাকে না বললেই চলে। সুভাষ কাপুরের কাছে তাই আশা বেশি ছিল, সে কারণই হয়তো হতাশাটাও বেশি।