অরুন্ধতী রায়
অরুন্ধতী রায়

অরুন্ধতী রায় অভিনয় করতেন, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও

বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায় অতিপরিচিত ও আলোচিত এক নাম। সমকালীন ভারতীয় সাহিত্যের আলোচনা তাঁর নাম ছাড়া অসম্পূর্ণ। আবার নিপীড়িত, অসহায় মানুষের অধিকারের পক্ষে সব সময় সোচ্চার কণ্ঠটিও তাঁর।

এই অরুন্ধতী রায় একসময় চিত্রনাট্য লিখতেন, অভিনয় করতেন, জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছেন। তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘মাদার মেরি কামস টু মি’–তে এসব নিয়ে আছে নানা তথ্য। আজ তাঁর জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে পড়ার গল্প।

গত শতকের আশির দশকের কথা। ভারতের স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিবেশবিদ প্রদীপ কৃষেণ একটি চিত্রনাট্য লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পান। এর আয়োজক ছিল ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এনএফডিসি)। তারা প্রদীপকে সেই চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা বানাতে উৎসাহ দেন।

অরুন্ধতী রায়

প্রদীপ কৃষেণ মোটামুটি কে কোন চরিত্রে অভিনয় করবেন, সেটা ঠিক করে ফেলেন। তবে মূল নারী চরিত্রের জন্য কাউকে মনে ধরছিল না।

একদিন তিনি তাঁর স্ত্রীর অফিসে গিয়ে কোঁকড়া চুলের, হালকা-পাতলা গড়ন আর চোখে গভীর কী যেন আছে; এমন এক তরুণীকে দেখতে পান। দেখেই তাঁর মনে হয়, তিনি-ই সেই নারী, যাকে তিনি সিনেমার জন্য মনে মনে খুঁজছিলেন।

অরুন্ধতী রায় যখন তরুণী

এই তরুণী হলেন অরুন্ধতী রায়। তিনি তখন দিল্লির স্কুল অব প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচার থেকে পাস করে স্থপতি হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন। স্ত্রীর মাধ্যমে প্রদীপ সেই তরুণীকে ডাকেন। তিনি কী চান, সেটা জানান।

তবে অভিনয় করার ব্যাপারে একদমই রাজি ছিলেন না অরুন্ধতী রায়। তিনি প্রদীপকে বলেছিলেন, অভিনয়ের অ-ও তিনি জানেন না, তা ছাড়া তাঁর হিন্দি ভীষণ খারাপ। প্রদীপ দমে যাওয়ার পাত্র নন। অরুন্ধতীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ওই চরিত্রের নাম শৈলা আর তাঁর কোনো সংলাপ নেই। গল্পটি সংক্ষেপে অরুন্ধতীকে শোনালেন। চিত্রনাট্যটি হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাড়ি গিয়ে ভালোভাবে ভেবে দেখতে অনুরোধ করলেন।

অভিনয়ের প্রস্তাবটি নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বললেন অরুন্ধতী রায়। সেই বন্ধু তাঁকে রাজি হয়ে যেতে বললেন। তিনিও ‘দেখি না কী হয়’ মনে করে রাজি হয়ে গেলেন। এভাবেই ১৯৮৪ সালে ‘ম্যাসি সাহেব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিনয়জগতে পা রাখেন অরুন্ধতী রায়। ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও সমালোচকদের মন জয় করেছিল।

‘ম্যাসি সাহেব’ সিনেমায় অভিনেতা রঘুবীর যাদবের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়

ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছিল। সিনেমার নায়ক ও পরিচালক উভয়েই দেশ-বিদেশে নানা পুরস্কার পেয়েছিলেন।

প্রদীপের বন্ধুরা মিলে প্রযোজনা সংস্থা করেন। তখন অরুন্ধতী রায়কে তাঁদের সঙ্গে কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি গল্পের খসড়া তৈরি করতে শুরু করেন।

২৬ পর্বের একটি ধারাবাহিকের চিত্রনাট্য লিখেন তিনি। নাম—‘বারগদ’। খুব উৎসাহ নিয়ে শুটিং শুরু করেন, তবে টাকার অভাবে মাঝপথে সব থেমে যায়। সেই ধারাবাহিক আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি।

এরপর অরুন্ধতী রায় ‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ানস’ নামের (১৯৮৯) একটি সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেন। সেখানে তিনি অ্যানি নামের চরিত্রে অভিনয় করেন। সেটার সঙ্গে অবশ্য তাঁর নিজের জীবনের মিল ছিল। অ্যানি স্থাপত্যবিদ্যার একজন, কিন্তু সেটা ছেড়ে তিনি লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়েন।

‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ানস’ সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন অরুন্ধতী রায়

এই সিনেমার জন্য সেরা চিত্রনাট্য বিভাগে অরুন্ধতী রায় সেবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এ ছাড়া অন্য ভাষার (ভারতের সংবিধানে উল্লিখিত ভাষা ছাড়া) সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কারও পেয়েছিল এটি, যা অরুন্ধতী রায়ের কাছে ‘প্রিয়তম পুরস্কার’। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেরও সুনাম কুড়িয়েছিল ‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ানস’।

অরুন্ধতী রায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের একটি বর্ণনাও দিয়েছেন তাঁর বইয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, অনুষ্ঠানটি ছিল গুরুগম্ভীর ও জাঁকজমকপূর্ণ।

মূলধারার চলচ্চিত্র জগতের অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালকসহ সবাই চমকপ্রদ পোশাকে হাজির। রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটারামন পুরস্কার তুলে দিচ্ছিলেন। যখন অরুন্ধতীর ডাক এল, তিনি মঞ্চে যাচ্ছেন পুরস্কার নেওয়ার জন্য; তখন এক আমলা তাঁর পোশাক দেখে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, পোশাকবিধি করতে হবে। কারণ, তিনি প্রতিদিনের সাধারণ পোশাক পরে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।

‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ানস’ সিনেমায় অভিনেতা অর্জুন রায়নার সঙ্গে অরুন্ধতী রায়
পরিচিতি
অরুন্ধতী রায়ের জন্ম ১৯৬১ সালে, ভারতের শিলংয়ে। শৈশব কাটিয়েছেন কেরালায়। স্থাপত্যবিদ্যায় পড়ালেখা করেছেন। তবে লেখালেখিতেই তাঁর মন ও খ্যাতি। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর জন্য বুকার পুরস্কার পান। সাহিত্যের বাইরে তিনি যুক্ত আছেন রাজনৈতিক ও মানবাধিকার আন্দোলনে। কাশ্মীর, নর্মদা আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী রাজনীতি—এসব বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচিত।

প্রদীপ ও অরুন্ধতী মিলে আরেকটি সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নেন। নাম—‘ইলেকট্রিক মুন’ (১৯৯২)। এই সিনেমার জন্য ব্রিটিশ টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল ফোর’ তাদের টাকা দিয়েছিল।

‘মাদার মেরি কামস টু মি’ বইয়ে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, তিনি এই চিত্রনাট্য মাথা দিয়ে লিখেছেন, মন দিয়ে নয়। ভালোবাসার মতো কিছু এটাতে তিনি পাননি। অনেকটা টাকার প্রয়োজনে যুক্ত থাকার মতো ব্যাপার ছিল।

‘ইলেকট্রিক মুন’ সিনেমার দৃশ্য, সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখেছেন অরুন্ধতী রায়

‘বিদেশি সিনেমা’ হিসেবে শুটিং করতে গিয়ে নানা দপ্তরের, কর্মকর্তাদের এত বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল যে অরুন্ধতী রায় খুব বিরক্ত হন। ছন্দে ফিরতে তিনি নিজের জন্য লিখতে শুরু করেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, লিখতে তাঁর খুব ভালো লাগছে। সিদ্ধান্ত নিলেন, সিনেমাজগতে আর না। তিনি শুধু লিখবেন, যা ইচ্ছা হবে তা-ই লিখবেন।

মা মেরি রায়ের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়, ২০২২ সালে মারা যাওয়া মাকে নিয়ে ‘মাদার মেরি কামস টু মি’ বইটি লিখেছেন তিনি

একদিন বেড়াতে এসে অরুন্ধতী রায়ের লেখার খাতা পড়ে মুগ্ধ হলেন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সানডে’র সম্পাদক। তিনি সেই লেখা নিয়ে নিজের কাগজে ছাপালেন। এভাবেই ১৯৯২ সালে প্রথম কোনো কাগজে তাঁর লেখা প্রকাশিত হলো। ওই বছরই তিনি ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন।

১৯৯৭ সালে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকাশিত হলে হইচই পড়ে যায়

পরের বছর ১৯৯৭ সালে এটি প্রকাশিত হলে হইচই পড়ে যায়। অরুন্ধতী রায় এই বইয়ের জন্য বুকার পুরস্কার পান। লেখালেখির পাশাপাশি ক্রমশ অধিকারকর্মী হিসেবে নানা কাজে জড়িয়ে পড়তে থাকেন তিনি।

তাঁর জীবন থেকে সিনেমাজগৎ একেবারেই হারিয়ে যায়। আসলে কী তাই! বরং উল্টো করে বলা চলে, সিনেমার জগতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, স্থপতি নন, অভিনেত্রী নন কিংবা চিত্রনাট্যকারও নন; তিনি শুধু লেখক হতে চেয়েছেন।